এমএমআর জালাল
প্রথম পর্ব
রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান।
ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথকেও জমিদারগিরি করতে হয়েছিল। এখানে একটি তবে আছে? সেটা হল অধিকাংশ সময়কালটাই বাবার হয়ে–পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের হয়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এর জন্য তিনি নিয়মিত বেতন পেয়েছেন।
১৮৮৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩১ বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্টেটের বেতনভোগী হিসাবে জমিদারি দেখেছেন। এই জমিদারির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সর্বমোট ৫০ বছর। তিনি প্রজাহিতৈষী জমিদার ছিলেন।
এই জমিদারগিরি নিয়েই একটি রবীন্দ্রবিরোধিতা দীর্ঘকাল থেকে নানা কায়দায় চলে আসছে। জমিদাররা যেহেতু শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি–সুতরাং তারা কোনোভাবেই ব্যতিক্রমী হতে পারেন না– ভাল হতে পারেন না। তারা যে কোনো প্রকারেই হোক না কেন প্রজানিপীড়ন করে থাকেন। এইরকম একটি সাধারণ সমীকরণ থেকে বলা যেতে পারে, জমিদার রবীন্দ্রনাথও প্রজানিপীড়ক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই নানাধরনের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বিরোধিরা তাঁর সাহিত্য কর্ম নিয়ে বিরোধিতা করে জুঁত করতে পারেনি–তখন তারা চোখ বুজে গৎবাঁধা আওয়াজটি দিয়েছেন–বাবু রবীন্দ্রনাথ প্রজানিপীড়ন করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের এই প্রজানিপীড়ন বিষয়ে সম্প্রতি একটি ব্লগে নতুন করে অভিযোগ করা হয়েছে। সে কারণে এই সিরিজে অনুসন্ধান করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে–'রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি' কেমন ছিল। বোঝার চেষ্টা করা হবে– প্রজানিপীড়নের অভিযোগটির ভাঁড়ার ঘরে কি আছে।
ঠাকুরদের জমিদারীর একটু খতিয়ান—
——————————————-
ডিহি শাহজাদপুর (সদর শাহজাদপুর), বিরাহিমপুর ( যার সদর কাছারি ছিল শিলাইদহে), কালিগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর) এবং উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুক। এছাড়াও নূরনগর পরগণা, হুগলির মৌজা আয়মা হরিপুর, (মণ্ডলঘাট) পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরূপপুর, যশোরের মহম্মদশাহী ইত্যাদি এলাকাও। গবেষক অমিতাভ চৌধুরীর তথ্যমতে নদীয়া (কুষ্টিয়া)ও ঠাকুর এস্টেটের অধীনে ছিল। তবে প্রধানত বিরাহিমপুর, কালীগ্রাম, শাহজাদপুর ও ওড়িশার কটকের জমিদারি ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের জমিদারি ঠাকুরদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তার কারণ অবশ্য জানা যায় না।
কিভাবে জমিদারিটা ঠাকুর পরিবারে পেলেন–নীলমণি থেকে দ্বারকানাথ
—————————————————-
জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুর ছিলেন ব্যবসায়ী। তার পুত্র রামলোচন ঠাকুর বিরাহিমপুর পরগনা (যার সদর কাছারি ছিল শিলাইদহে) জমিদারী কিনেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি। জমিদারী কিনে পীরালী ঠাকুরদের মধ্যে তিনি কিছুটা আভিজাত্য অর্জন করেছিলেন।
রামলোচন ঠাকুর মৃত্যুর আগে তার দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ১৮০৭ সালে এ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র তের বছর। তার বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পত্তি রামলোচন ঠাকুরের স্ত্রী অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের বড় ভাই রাধানাথ দেখাশুনা করতেন। সে সময় শিলাইদহ এলাকাটির সুনাম ছিল না। প্রজারা 'দুর্বৃত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ' ছিল। এ জন্য জমিদারী পরিচালনার আইন-কানুন সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার ফার্গুসনের কাছে ভাল করে জেনে নেন।
আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে ১৮১৮ সালে তিনি চব্বিশ পরগনার কালেক্টরের শেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সালে শুল্ক ও আফিং বোর্ডের দেওয়ান হন।
১৮৩০ সালে কালীগ্রাম পরগণা কিনেছিলেন। এ ছাড়া উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুক তাঁর ছিল। ১৮৩৩ সালে বিরাহিদপুরের কুমারখালি মৌজায় অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশমের কুঠিটি তিনি কিনে নিলেন। ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুর কেনেন।
সাজাদপুরের জমিদারিটি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রানী ভবানীর নাটোরের জমিদারির নীলাম থেকে। দাম পড়েছিল ১৩ টাকা ১৩ আনা।
অথ জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাচার
———————————————
১৮৪৬ সালে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে তাঁদের হাউসের দেনা এক কোটি টাকা, পাওনা সত্তর লক্ষ টাকা। ৩০ লক্ষ টাকার খবর নাই। ঠাকুর পরিবার গরীব হয়ে গিয়েছিল। সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী লিখেছেন—যাঁহার পিতার ডিনার তিনশত টাকার কমে হইত না, তিনি চারি আনা মূল্যের ডিনার খাইয়া তৃপ্ত হইতেন। সেসময় ১৮৫৫ সালে ঋণের দায়ে দেবেন্দ্রনাথ কারারুদ্ধ হওয়ার পথে। তিনি সংকল্প করলেন দেনা তিনি শোধ করবেন। দেউলিয়া ঘোষিত হবেন না। ছয়মাসের মধ্যেই অবস্থা সামলে ওঠেন। তাঁদের কোনো ব্যবসা বানিজ্য রইল না। শুধু জমিদারীটি টিকে ছিল। তিনি গরীব হওয়ার কারণে বিষয় সম্পত্তিতে মনোযোগী হলেন।
দ্বারকানাথ তাঁর উইলে তিন ছেলের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি ভাগ করে দিলেও মৃত্যুর পরে জমিদারি এসে পড়েছে তার বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথের উপর। শিলাইদহে গিয়ে নিজেই জমিদারী পরিচালনা করা শুরু করলেন। গিরীন্দ্রনাথের ভাগে পড়েছিল শাহজাদপুর পরগণা।
দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটো দুই ভাই গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথের অংশের জমিদারি পরিচালনাও এক সঙ্গে করতেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। দেবেন্দ্রনাথের পরামর্শে গিরীন্দ্রনাথ ব্যবসা দেখতেন। তিনি ভাল ব্যবসা বুঝতেন। দ্বারকানাথের অধিকাংশ ঋণই গিরীন্দ্রনাথের সুযোগ্য পরিচালনায় ব্যবসার আয় থেকে শোধ করা হয়। গিরীন্দ্রনাথ ১৮৫৪ সালে মারা যান।
দ্বারকানাথের ছোটো ছেলে নগেন্দ্রনাথ বিলাসী ছিলেন। তিনি সেই পারিবারিক ঋণগ্রস্থ অবস্থায়ও বিপুল পরিমাণ ঋণ করেন। এটা নিয়ে বড় ভাই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিমান করে ছোটো ভাই নগেন্দ্রনাথ কলকাতা ছেড়ে বহুদূরে চলে যান। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তার কোনো সন্তান ছিল না। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে দ্বারকানাথের এই বিপুল জমিদারি দেবেন্দ্রনাথের একার উপরই পড়ে।
গিরীন্দ্রনাথের দুই ছেলে গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ অকালে মারা যান। গণেন্দ্রনাথের ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার। দেবেন্দ্রনাথ ব্যবসা বিষয়ে তার উপরে নির্ভর করতেন। তিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে কলেরা রোগে মারা যান। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে গিরীন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে গুণেন্দ্রনাথও মারা যান। গুণেন্দ্রনাথের নাবালক তিন ছেলের গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের জমিদারী অংশও দেবেন্দ্রনাথকে পরিচালনা করতে হয়। তিনি তাঁদের প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিতেন।
পরবর্তীকালে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে সরাসরি জমিদারি পরিচালনা করা ছেড়ে দেন। ব্রাহ্ম ধর্ম পালন ও প্রচারে সময় ব্যয় করেন। দেবেন্দ্রনাথ জমিদরি ছেড়ে দিলে তাঁর প্রতিনিধি হয়ে এই জমিদারিগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিচালনা করেছেন বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বড় জামাই সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ও মেজো ছেলে অরুনেন্দ্রনাথ, সারদাপ্রসাদের ছেলে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তখন আয়ের উৎস দাঁড়িয়েছিল শুধুমাত্র প্রজাপ্রদত্ত খাজনা ও অন্যান্য আদায়। বাড়ির পুরুষরা প্রায় কেউই জমিদারী পরিচালনায় অংশ নেন না, কালে ভদ্রে মহালে যান। সেখান থেকে অর্থ আসে। তাঁরা ছিলেন জমিতে অনুপস্থিত জমিদার। পরিবারের সদস্যদের অনেকে সে সব অঞ্চল চোখে পর্যন্ত দেখেন নি। তাঁরা বিলাসী জীবন আর নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন। তবে দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে জমিদারী দেখতে গেছেন। সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন—দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রের মধ্যে দার্শনিকতা ও বৈষয়িকতার অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান ছিল। সব কিছু থেকে দূরে থেকেও তিনি তাঁর জমিদারী, আদি ব্রাহ্মসমাজ ও পরিবারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারির শুরুর আগে–
—————————————–
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে বক্সার থেকে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথকে লেখেন—এইক্ষণে তুমি জমীদারির কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিল বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতিসপ্তাহে আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্তমতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্য্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফঃস্বলে থাকিয়া কার্য্যভার অর্পণ করিব। না জানিয়া শুনিয়া এবং কার্য্যের গতি বিশেষ অবগত না হইয়া কেবল মফঃস্বলে বসিয়া থাকিলে উপকার কিছুই হইবে না।
শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ নিয়োগ করেছিলেন জমিদারী পরিদর্শক হিসাবে। সেটা ১৮৮৯ সালের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছেন।
অই সময়ে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজারের দ্বায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ছিলেন ঘরজামাই। যে কোনো বৈষয়িক ব্যাপারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবাস থেকে পত্র লিখে তাঁকেই নির্দেশ দিয়েছেন বলে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের রাত্রে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। আকস্মিকভাবে শিলাইদহে তাঁর মৃত্যু হয়। সংবাদটি এসে জোড়াসাঁকোয় পৌছায় পরের দিন। শোকের আঘাতে সমস্ত আনন্দঅনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
সারদাপ্রসাদের মৃত্যু, কয়েকমাস পরে কাদম্বরী দেবী ও দেবেন্দ্রনাথের পুত্র হেমেন্দ্রনাথের দেহত্যাগ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজী ব্যবসা ইত্যাদিতে শৃঙ্খলায় জমিদারি ও আর্থিক বিলিব্যবস্থার ভার নির্দিষ্ট কারো উপরে দিতে ভরসা পাননি। এর আগে দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখতেন। ১২৯১ (১৮৮৪) সাল থেকে জোড়াসাকোর হিসাবপত্র বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখতেন। তিনি এই কাজটি পছন্দ করতেন না। মাত্র দেড় মাস পরে তাই তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিপেন্দ্রনাথ ২৩ আগস্ট ১৮৮৪ তারিখ থেকে ঠাকুরপরিবারের জমিদারির হিসেবপত্র পরীক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর এই কাজ করেন। এরপর দেবেন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে রবীন্দ্রনাথের উপর এই দায়িত্ব এসে বর্তায়। সে সময় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য চর্চার ফাঁকে ফাঁকে কাছারিতে নিয়মিত বসে জমিদারির কাজকর্ম শিখতেন।
২ আষাঢ়, ১২৯৬ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন জোড়াসাকোর কাছারির হিসাবপত্র দেখার দায়িত্ব। ১০ অগ্রহায়ণ, ১৩৯৬ তারিখে পেয়েছিলেন জমিদারি পরিদর্শনে অধিকার (নভেম্বর, ১৮৯০)।. এতদিন অবসর মতো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শন করেছিলেন। (১১ অগ্রহায়ণ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ, সোমবার) ২৫, ১৮৮৯ সালে নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবী, একজন সহচরী, মেয়ে মাধুরীলতা (বেলা) ও পুত্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে শিলাইদহে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে গেলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জমিদারি কাজে কোলকাতায় নহে, শিলাইদহে --
——————————————————
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে প্রথমবার গেছেন বাল্যকালে বাবা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিতীয়বার ১৮৭৫ সালে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে। তৃতীয়বার গেলেন জমিদারি পরিদর্শনের কাজে। সঙ্গে পরিবার।
তারা তখন শিলাইদহে একটি বোটে থাকা শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে একটি পত্রে জানাচ্ছেন—শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কোলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাতে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদ্য় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।
২৮ নভেম্বর বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৃণালিনী দেবী, বেলা, সহচরীসহ চরে বালিহাঁস দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে ব্যস্ত। তিনি সঙ্গে আসেননি। বলেন্দ্রনাথরা চরে ফেরার পথ খুজে পাচ্ছেন না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় দেখা যাচ্ছে, মৃণালিনী দেবী ভালই হাঁটতে পারছেন। কিন্তু সহচরী অমলা দাশ হাঁটতে পারছেন না। ভয়ে তার গা হিম হয়ে আসছে। মাটি ফুঁড়ে যে কোনো সময় ডাকাতদল বের হয়ে আসতে পারে। শেষে উঁচু জমিতে উঠতে একদল মেছোদের দেখা পেলেন। তারা ফেরার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, সকালে মৌলভী সাহেব এক দঙ্গল প্রজা নিয়ে এসেছেন। তারা রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের অভাব অভিযোগ প্রার্থনা জানাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ শুনে তার প্রতিকার করছেন।
সে সময় বোট গ্রাম্য গাইয়েদের আগমণ ঘটত। তার মধ্যে দুজন মার্কামারা হয়ে গিয়েছিল। একজন বৈষ্ণব—সে কাঙাল ফিকিরচাঁদের গান গাইত, আরেকজন সুনা-উল্লাহ। এক-একদিনের পালায় দুআনা করে পয়সা বরাদ্দ ছিল। নিয়মিত বরাদ্দ ছাড়াও মৃণালিনী শাড়ি, সাংসারিক টুকিটাকি ওদেরকে দিতেন। বলেন্দ্রোনাথ এ সময় সুনা-ওল্লাহর মুখ থেকে শোনা ১২টি গান খাতায় লিখে রেখেছেন। এর মধ্যে ২ সংখ্যক গানের রচয়িতা গগণ মণ্ডল। তিনি গগণ হরকরা নামে পরিচিত। গানটির নাম আমি কোথায় পাব তারে। রবীন্দ্রনাথ সেগুলো শুনছেন। তাদের সঙ্গে আসরে বসছেন। পল্লীগানের সংকলন তৈরি হচ্ছে তার নির্দেশনায়।
পরিদর্শক থেকে আমমোক্তার জমিদার রবীন্দ্রনাথ
—————————————————–
রবীন্দ্রনাথের জমিদারী কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৬ সালে ৮ আগস্ট বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পক্ষে জমিদারি পরিচালনার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি করে দেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত এই আমমোক্তারনামা দলিলে দেবেন্দ্রনাথ স্বাক্ষর করেন।Tagore Family Papers, Doc. No.68—এর উপরে লেখা আছে—Power of Attorney from Debendranath Tagore to Rabindranath Tagore on 8th August 1896 in the presence of Mohini Mohan Chatterjee, Solicitor, Cal./Presented between the hours 10 to 11 on on the 8th august 1896. এই দলিলের বলে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি-পরিচালনা করেছেন। তখনো বেতন পাচ্ছেন।
আমমোক্তারনামা নিয়ে বাবা দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনা করেছেন। তারপর নিজে জমিদারির মালিকানা পেয়েছেন ১৯২০ সালের ৮ মে।।
এইভাবে কবি রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি শুরু হয়েছে।
পোস্টসূত্র :
————–
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ :ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায়–
গ্রন্থসূত্র :
———
১. রবিজীবনী–প্রশান্তকুমার পাল
২.রবিজীবনকথা–প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৩. রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন — সমীর সেনগুপ্ত
৪. ছিন্নপত্র : রবীন্দ্রনাথ
৫. হাজার বছরের বাঙাল সংস্কৃতি গোলাম মুরশিদ
৬. জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধুরী
৭. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ
৮. স্মৃতিসম্পুট, রবীন্দ্রস্মৃতি; পুরাতনী–ইন্দিরা দেবী :
কুলদা রায় ও এমএমআর জালাল লিখিত রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ সিরিজের লিংক
——————————————————————————————–
১. বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও রবীন্দ্রনাথ : 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি' থেকে 'বিশ্বপরিচয়'—
প্রথম পর্ব : লিংক, দ্বিতীয় পর্ব: লিংক, তৃতীয় পর্ব : লিংক
২. আমি কোথায় পাব তারে থেকে আমার সোনার বাংলা
৩. রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ : পাকিস্তান পর্ব
৪. রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নাই : প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব
৫. এইখানে গান নিয়ে আলোচনা চলিতেছে : কুলদা রায়–
দ্বিতীয় পর্ব———————————————-
জমিদারির খোঁজে
—————-
কলিমখানের : জন্মসূত্র–জমিপুত্র–
বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষে ৩৮৯ পৃষ্ঠায় কলিম খান রবি চক্রবর্তী লিখেছেন : জমি–(জমিদার, জমী, জমীন, জমীনদান)
জমি শব্দটি এসেছে জম থেকে। জম অর্থ—গতিশীল যাহাতে।
জমি—পৃথিবী, ভূতল, মাটি, কৃষিক্ষেত্র, চাষের ভূঁই, কাপড়ের পিঠ (Surface) বা বুননি (Texture), চিত্রপটের তলদেশ (Ground)।
জমিদার—ভূস্বামী, রাজা। Land—অর্থে জমি এবং Landlord-অর্থে জমিদার শব্দটি প্রচলিত।
যতদূর বোঝা যায়, ভূতলের অংশ বা কৃষিক্ষেত্রের লেনদেন শুরু শুরু হওয়ার পরেই জমি ও জায়গা শব্দদুটির সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, দুটি শব্দের ভিতরেই 'ই' বা গতিশীলতা রয়েছে। জমি-তে ই-কার রয়েছে সরাসির, জায়গাতে ই রয়েছে 'য়'—এর ভিতরে। কিন্তু কলিম খানের প্রশ্ন হল—জমিজায়গা গতি পায় কিভাবে?
তিনি বলছেন, জমিজায়গা হেঁটে-চলে বেড়ায় না। একবস্তা ধান কাউকে দিয়ে দেওয়ার মতো জমিজায়গা কাউকে হাতে তুলে দেওয়া যায় না, কেউ তা কাঁধে করে স্থানান্তরে নিয়ে যেতেও পারে না। অথচ একালের মানুষ মাত্রেই জানেন, জমিজায়গা দিয়ে দেওয়া যায়, দান করা যায়, বিক্রি করা যায় এবং অন্যে তা নিয়েও নিতে পারে। কী করে তা সম্ভব হয়?
কার্যত জমিদান, জমিক্রয় ইত্যাদি ব্যাপার মানবসভ্যতার একটা অদ্ভুত আবিষ্কার। বিষয়টিকে বুঝবার জন্য কলিম খান বলেন, সর্বাগ্রে জানা চাই, ভূতলের কি কোনো অধিকারী বা মালিক হয়? হ্যা, হয়। ভূতল যাদের অস্তিত্বের ভিত্তি, তেমন সমস্ত জড় ও জীবই ভূতলের প্রতিটি বিন্দুর অধিকারী। জড় থেকে জীবের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্রমান্বয়ে উচ্চতর উত্তরণের সমস্ত ধাপে পেরিয়ে এই ভূতল মানুষের সৃষ্টি করেছে। সেই কারণে এই পার্থিব জগৎ হল অস্তিত্বের মাতা, মানুষ হল তার শ্রেষ্ঠ সন্তান; তার সর্বাধিক আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষম বুদ্ধিমান ছেলে; অন্যেরা তুলনায় কম আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষম। যে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে অন্যের সাহায্যে সাহায্য স্বভাবতই করতে পারে না। মানুষই একমাত্র পারে এই বিশ্বের সকল জীব ও জড়কে রক্ষা করে সবাইকে নিয়ে চলতে। ফলত, ভূতলকে কিভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে তার সিন্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জন্মে যায়। ফলত, বিশ্বের সমস্ত মানুষ সমগ্র ভূতলের প্রতিটি বিন্দুর মালিক হয়ে যায়। আর, এই মালিকানার ধারণা চলে আদিম যুগ থেকে মহেঞ্জোদাড়োর যুগ পর্যন্ত। এই সময় পর্যন্ত ভূতল হাঁটা-চলা করতে পারেনি, গতিশীল হয়নি।
কিন্তু সুবিধাবাদিতার পাল্লায় পড়ে সেই মানুষ একদিন আত্মকলহে জড়িয়ে পড়ে। পরমাপ্রকৃতি তাকে সাধারণভাবে 'শিবতার' এবং প্রয়োজনে 'দক্ষতার' ব্যবহার করবার যোগ্যতা দিয়েছিল। নিজের নাবালকত্বের কারণে সে অপ্রয়োজনেও দক্ষতার ব্যবহার শুরু করে দেয়। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ মানবসমাজে মৌলবিবাদের জন্ম হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় সম্প্রদায় ও সম্প্রদায় পরিচালক মহর্ষিদের বা জ্ঞানীমানুষদের। সেই সম্প্রদায় সৃষ্টির কালে আদি জ্ঞানীগণকে বা কশ্যপকে পৃথিবী দান করে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে যায়; আদিম যৌথসমাজের প্রতিটি মানুষ তাদের তিনটি অধিকার জ্ঞানীগণকে দান করে দেয়; যার তৃতীয়টি ছিল ভূতলের উপর প্রত্যেক মানূষের নিজ নিজ অধিকার। ভূতলের অংশ বা জমির হাঁটা-চলার সূত্রপাত হয়ে যায় সেই থেকে। এই অবস্থাতেই কেটে আরও হাজার বছর।
তারপর একদিন মহর্ষি (জ্ঞানী, ব্রাহ্মণ, মন্দির-চার্চ-মঠ-মন্দিরের অধিকারী) তাঁর অধিকারের ভূমির দেখভাল করার জন্য রাজা নিয়োগ করেন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। রাজা ও রাজার সাগরেদ রূপে সামন্তগণ জমির দেখভালের দায়িত্বও পেয়ে যান, কিন্তু তারা তো আর চাষ করেন না। অতএব তারা সে অধিকার দিয়ে দেন রায়তদের। এরপর এক রাজা আরেক রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসে, দেখভালের কাঁধবদল হতে থাকে; যদিও গোড়ায় থেকে যায় আদি জ্ঞানজীবী মন্দির-মঠ-চার্চ-মসজিদ এবং শেষ সীমায় থেকে যায় একই রায়ত। এর মাঝে জমির যে লেনদেন চলতে থাকে, তা কেবলমাত্র দেখভালের-চাষাবাদের অধিকারের লেনদেন।
মুগলদের জমিদারি বেত্তান্ত—
মুগল আমলে জমিদার বলতে প্রকৃত চাষির ঊর্ধ্বে সকল খাজনা গ্রাহককে বোঝানো হতো। প্রকৃত চাষি জমিদার নয়, কারণ সে কখনও তার জমি খাজনা বা ভাড়ায় অন্য কাউকে প্রদান করে না। জমিদাররা শুধু খাজনা আদায়ের স্বত্বাধিকারী, জমির স্বত্বাধিকারী নয়। পক্ষান্তরে, জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি যাদের নামে জমাবন্দি বা রেন্ট-রোল তৈরি হতো। এই ধারণায় জমিদারগণ রাজস্বের চাষি ছিল মাত্র। এরা ছিল সরকার এবং হুজুরি(স্বতন্ত্র) তালুকদার ব্যতীত নিম্নস্তরের রাজস্ব চাষিদের মধ্যস্থ পক্ষ। হুজুরি তালুকদারগণ খালসায় (খাজাঞ্চি খানায়) সরাসরি রাজস্ব প্রদান করত।
জমিদার এই পদবি বা শব্দটি ভূঁইয়া বা ভূপতি নামে যে দেশীয় পারিভাষিক শব্দটি প্রচলিত আছে তার সরাসরি প্রতিশব্দ বলা যায়। এই ভূঁইয়া বা ভূপতিরা ছিল ভারতের প্রাক্-মুগল আমলের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক। মুগলগণ তৎকালে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাকে তাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তর করে। অবশ্য চিরাচরিত ক্ষমতা ও উৎপাদনের উপায়গুলি তেমন বিশেষ পরিবর্তিত হয় নি।
টোডর মল্লর বন্দোবস্ত (১৫৮২) যা দূরবর্তী বাংলা সুবায় একদিন জমিদারি পদ্ধতির সূচনা করেছিল, তা ১৬৫৮ সন পর্যন্ত বজায় থাকে। এই সময়ে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজার (১৬৫৭) রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থায় কিছুটা বল সঞ্চার হয়। এরপর ১৭২২ সনে সুবাহদার মুর্শিদ কুলির মালজমিনি (ভূমি রাজস্ব) পদ্ধতি প্রচলিত হয়। সরকারি রাজস্ব সর্বাধিক করা ও রাজস্বের নিয়মিত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য মুর্শিদ কুলি বাংলা প্রদেশকে পূর্ববর্তী চৌত্রিশটি সরকারের পরিবর্তে তেরটি চাকলায় (প্রশাসনিক বিভাগ) ভাগ করেন। আর সেসঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জমিদারদের চাকলাদারের এখতিয়ারাধীন করেন। এই চাকলাদারগণ মনোনীত হন বৃহৎ জমিদারবর্গ থেকে আর তারা জমির মালিক হিসেবে নয় অধস্তনদের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তাদের কাজ ছিল দক্ষতার সঙ্গে রাজস্বের আদায় ও সংগ্রহ নিশ্চিত করা। তবে প্রধান জমিদারগণকে রাজস্বের রাজকীয় অংশের জন্য খালসা বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কাছে জবাবদিহি করার ফলে তাদের সনাতন ক্ষমতা ও মর্যাদাগত অবস্থান আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও প্রতিভাবান জমিদারগণকে বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্তির যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার ফলে রাজদরবারে তাদের অবস্থানগত মর্যাদা বৃদ্ধি ও সেসঙ্গে তাদের নিজ স্বার্থকে আরও এগিয়ে নেবার সম্ভাবনা অনেক দূর প্রসারিত হয়। রাজস্ব ব্যবস্থাপকের ভূমিকা থেকে জমিদারে রূপান্তরিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি আঠারো শতকের মাঝামাঝি নাগাদ সম্পূর্ণ হয়।
সময়ের চিত্র : ফ্রম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো থেকে—
কোটচাঁদপুর সরকার যশোহরের একটি মহাল। মোট পরিমাণ ফল ৮৩২০ বিঘা। আকবর বাদশার আমলে স্থির হয়েছিল—লড়াই-হামলার সময়—মহাল কোটচাঁদপুর আগ্রাকে দেবে ২০০ ঘোড়সওয়ার আর ১০১ জন পদাতী। .ঘোড়সওয়ার বা পদাতী দিতে না পারলেও মহান কোটচাঁদপুর শাহী খাজনা-খানায় পুরো মুল্য ধরে দিত—ফৌজদারের হাদ দিয়ে। কড়ায়-ক্রান্তিতে। আশরাফিতে—মোহরে।
লেখাটিতে একজন পথিককে দেখা যাচ্ছে। তিনি পায়ে হেঁটে আসছেন কোটচাঁদপুরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পথিক দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পায়ের ফাঁক দিয়ে দুটি বনমোরগ ছুটে পালাল। দূরে বনশুয়োরের ঘোত ঘোত। পথিক এক একই বলে উঠলেন, আগে এখানে একটা গাঁ ছিল। এখন নেই। মুছে গেছে। বসতি মুছে যাওয়ার পরে এখানে বোধ হয় কোনওখানে মানুষজন মানত করতে আসে। তাদের মানত করা মুরগিগুলো এখন বনমোরগ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে বনজঙ্গল বেড়ে যাওয়ায় বনশুয়োর এসে জুটেছে।
পথিক জানেন, কোটচাঁদপুরে রাত জেগে থাকত। তাঁতীরা খটখট করত। নেই। শুন্য। ভিটেমাটি। জঙ্গল। গ্রামটি মুছে গিয়েছিল—মগদের লুটপাটের কারণে। পথিকের চার ভাইপোকে মগরা ধরে নিয়েছিল। আর নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির কিশোরী মেয়েটিকে। এদেরকে দাস হিসেবে বেঁচে দেওয়া হয়েছে সেসময়ে। সে সময়ের শাসকবর্গ মগ দস্যুদের দমনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রজারা বাঁচল কি মরল এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল প্রজাদের কাছ থকে খাজনা আদায় করা।
সে সময় মুর্শিদ কুলি খাঁ বলছিলেন, বাদশার পাওনা হল-বিঘা পিছু চার মণ গম, চার মণ যব, আড়াই মণ সরষে, সাড়ে তিনমন ছোলা বা মটর আর ছমন কলাই। কিন্তু জমিতে যদি পেঁয়াজ, লেবু, শাকসবজি ফলে—তাহলে নগদ তনখায় খাজনা দিতে হবে। এছাড়াও নীল, পান, তেতুল, গাজা, চুবড়া আলু, শাকালু, লাউ, কুমড়ো ফলানের নগদে খাজনা চাই। এসব হিসেব করার জন্য কানুনগোরা গ্রামে গ্রামে যায়। গরু মোষ রক্ষায় গোসেমারি খাজনা চালু কর হয়েছিল। ফলবান গাছের উপর খাজনা, সরদবক্তি, শান্তি রাখতে দারোখানা খাজনা, সরাফি, হাসিলবাজার—সব রকম খাজনার পাশাপাশি গাঁজা, কম্বল, তেল, কাঁচা চামড়ার উপরেও কর বসেছে প্রয়োজনে।
মুগল বনাম বণিক : দ্বৈতশাসন–
১৭৫৭ সালে সিরাজউদদৌলা ইংরেজ বণিকদের হাতে পরাজিত হওয়া পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার এবং ওড়িশার দেওয়ানী লাভ করে ১৭৬৫ সালে। এই সময় থেকে আরম্ভ করে কিছুকাল একই সঙ্গে চলতে থাকে নবাব এবং কোম্পানীর দ্বৈতশাসন।
ইরানী ভাগ্যান্বেষী রেজা খানকে নবাবের নায়েমে নাজিম করে শাসন ব্যবস্থা চালানো হয়। তাকে দেশীয় আইন-কানুন ও প্রথা অনুযায়ী দেশ শাসন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থাটি ১৭৬৭ সন অবধি ভালভাবেই কার্যকর ছিল। ঐ বছরেই ক্লাইভ এদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে বিদায় নেন। ক্লাইভের সমর্থনে রেজা খান দক্ষতার সাথেই কোম্পানির রাজ্য শাসনে সক্ষম হন। তবে পৃষ্ঠপোষক ক্লাইভ-এর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেজা খানকে ফোর্ট উইলিয়ামের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের চরম বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের এসব কর্মকর্তা রাতারাতি ধনী হবার বাসনায় রেজা খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। তারা পর্যায়ক্রমে রেজা খানের হাত থেকে প্রশাসন নিজেদের হাতে তুলে নেন। তাদের এ হস্তক্ষেপের বিষয় প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভিন্ন জেলায় ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের মাধ্যমে। রেজা খান অভিযোগ করতে থাকেন যে এই নবনিযুক্ত কর্মকর্তারা পল্লী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে কোম্পানি কর্মকর্তারা দেশের পল্লী জনপদগুলিতে লুটপাট চালাচ্ছে।
এর ফলে রাজস্বের দাবি রাতারাতি বেড়ে যায়। ১৭৬৪ সালে যেখানে ভূমি রাজস্ব ছিল মাত্র ৮১ লাখ টাকা, সেখানে পরের বছর তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৮ লাখে। আর সাত বছর পরে ১৭৭৩ সালে এই রাজস্ব ধার্য হয় ৩ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত রাজস্বের দাবিতে বাংলার কৃষি ব্যবস্থা য় রীতিমত বিপর্যয় ঘটে। এ সময় একটি অসাধারণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষটির নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই ছিয়াত্তর বাংলা সন ১১৭৬, ইংএরজি হিসেবে ১৭৭০ সালের প্রথম দিকে। এই দুর্ভিক্ষে চাষীদের অর্ধেকই মারা গিয়েছিল। আর মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই প্রাণ হারান। অতিরিক্ত রাজস্বের দাবিতে জমিদাররা অত্যাচার শুরু করেন। তাতে অতিষ্ট হয়ে অধিকাংশ চাষী অন্যত্র পালিয়ে যান। বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ফসলি জমি লোকের অভাবে ঝোপ-জঙ্গলময় হয়ে ওঠে।
১৭৮১ সালের একটি পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একমাত্র রংপুরের উর্বর জমি ছেড়ে ৩০ হাজার পরিবার কোচবিচার চলে গিয়েছিল। এভাবে চাষীরা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ায় এবং মারা যাওয়ায় জমিও হয়ে পড়েছিল অনাবাদি। ফলে রাজস্ব আদায়ে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল।
কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ই আগস্ট, ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল দেওয়ানি প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে। নায়েব দেওয়ান রেজা খানকে পদচ্যুত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে কারারুদ্ধ করা হয়।
তৃতীয় পর্ব————————————
বাকী রাখা খাজনা
মোটে ভাল কাজ না।।
( –হীরক রাজার দেশ/ সত্যজিৎ রায়)
খাজনা আদারের কাছারি:
মুগল বাদশা জমির মালিক। তার কাছ থেকে কৃষক বা রায়তরা জমির সাময়িক মালিকানা নিয়ে চাষবাস করত। এর মধ্যে এই প্রজা বা রায়তদের কাছ থেকে জমির খাজনা আদায়ের জন্য মুগল বাদশা মধ্যবর্তী লোক হিসাবে জমিদার নিয়োগ দিতেন। জমিদার জমির মালিক ছিলেন না। খাজনা আদায়কারী মাত্র। জমিদাররা খাজনা আদায়ের কাজটি ভালমতো করতে পারলে বাদশার তরফ থেকে খিলাত বা উপাধী জুটত। এই খিলাত দিয়ে ক্ষুদে জমিদারী থেকে বড়ো জমিদারি পেতে সুবিধা হত। চোর থেকে ডাকাত হতে কাজে লাগত। তবে কিভাবে—কোন প্রক্রিয়ায় সেই খাজনা আদায় করা হত—সেটা নির্মম কী ভয়ঙ্কর ছিল, তা বিবেচনা করার কোনো দরকার ছিল না বাদশার। এই তনখা পাওয়াটাই ছিল শাহীর জন্য আল্লার নেয়ামত।
তাহলে খাজনা—দেখি তোমার সাজনা:
জমিদাররা তিন ধরনের খাজনা আদায় করে বাদশার খালসা বা কোষাগারে জমা দিত।
এক. খাজনা মানে মাল :
আবাদি ফসলী জমি ও অফসলী জমি যেমন, ফলজ-বনজ গাছপালা, বনজঙ্গল, জলাভূমি ও পুকুর থেকে যে খাজনা আদায় করা হত, তার নাম ছিল মাল। (এখান থেকেই টাকা পয়সাকে মাল বলা হয়। বলা হয়—মাল-কড়ি কেমন কামাচ্ছেন ভাই?)
দুই. সেইর খাজনা :
নদীপথে যেসব নৌযান চলাচল করত, যেসব হাঁট-বাজার বসত গ্রামে গঞ্জে তাদের কাছ থেকে সেইর খাজনাটি আদায় করা হত। এছাড়া যারা বিভিন্ন ধরনের কাজকারবার করত—সেইসব পেশাজীবী বা কর্মজীবীদের কাছ থেকে আদায় করা হত বেশ মোটা অঙ্কের খাজনা। এটার নামও ছিল সেইর খাজনা।
তিন. বাজে জমা খাজনা :
বিভিন্ন ধরনের জরিমানা, প্রতারণা ও বিয়েশাদি থেকে এই ধরনের জরিমানা আদায় করা হত।
খাজনা কি করে ধার্য হত:
এই খাজনা আদায়ের জন্য জমিজিরেতের সঠিক জরিপ ছিল না। একটি সংক্ষিপ্ত হিসাব থেকে খাজনা ধার্য করা হত। একে বলা হত আসনাসাক। জমিদারের কাজ ছিল বাদশাহী থেকে ধার্যকৃতএই খাজনা আদায় করে দেওয়া।
ধার্যকৃত খাজনার টাকা বিভাজন করে জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। তবে মুগল আমলে জমিদাররা প্রজারাদের বেশি খেপিয়ে তুলত না। বেশী ঝামেলা সৃষ্টি হলেই বাদশা জমিদার পাল্টে দিতেন। ফলে জমিদারী টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই প্রজাদের অনুগত রাখার দরকার হত। জমিদাররা প্রজাদের খুশি রাখতে তাদের কিছু দাবীদাওয়া মেনে নিতেন। তাদের দেখভালের কিছু কাজ করতেন।
সকলপ্রকার জমিদারদের পুলিশ, বিচার ও সৈন্যসামন্তর দায়দায়িত্বও বহন করতে হত। জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য পাইক বরকন্দাজ থাকত। এরা খাজনা আদায়ের কাজে সহযোগিতা করত। আবার স্থানীয় চুরি ডাকাতি দস্যুদের উৎপাত থামানোর কাজ করত। বড় জমিদারদের আওতায় থানা ছিল। সেখানে নিয়মিত পুলিশ থাকত। থানা অধিনে একাধিক চৌকি বা পাহারাস্থল ছিল। এদের কর্মীদের নাম ছিল চৌকিদার। থানার প্রধান ছিল ফৌজদার। ফৌজদাররা বাদশার লোক হলেও তারা জমিদারদের অধিনেই কাজ করত। এসবই ছিল খাজনা আদায়ের নানাবাহিনী।
মুগলদের নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। যুদ্ধের জন্য, বিদ্রোহদমনের সময়, বা পররাজ্য দখলের কাজে বাদশাহীতে সৈন্যসামন্ত, ঘোড়া-হাতি এগুলোর যোগান দিতে হত জমিদারদের। এই উপলক্ষ্যে প্রজাদের ঘাড়ে বাড়তি কিছু খাজনা চাপিয়ে দেওয়া হত।
জমিদাররা ছোটোখাটো বিচারআচারও করতেন। তাদের ছিল জমিদারী আদালত। এই আদালতে যেসব বিচার সম্ভব হত না—তা পাঠিয়ে দেওয়া হত থানাদার বা কাজির কাছে। সাধারণত রায়ত বা প্রজাদের পক্ষে রায় যাওয়াটা ছিল দৈবদুর্ঘটনা। বাদশার স্বার্থ-জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে যেটুকু বিচার করা সম্ভব—সেখানে তা-ই করা হত।
সে সময়ের লোকছড়ায় এই খাজনার ভয়াবহতা ধরা পড়েছে–
খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল : পাঁচশালা বন্দোবস্ত—
সে সময়ে কোম্পানী বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে যায়। তাদের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই সমস্যা মোকাবেলায় কোম্পানী তরফ থেকে ১৭৭২ সালে নিলামের মাধ্যমে জমিদারিগুলো পাঁচবছরের মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। এই পাঁচসালা বন্দোবস্ত স্থির করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটিকে। এই কমিটির আরও দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ (চাষীদের) থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশীয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার, কানুনগো আর আমলাদের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হলো ব্রিটিশ কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়কর্তা। কানুনগোদের কাছে প্রজাদের জমিজিরতের—খাজনাপাতির হিসেবপত্র-দলিলদস্তাবেজ থাকত। তাদের বাতিল করার ফলে নতুন করে যে যে কোনো হারে খাজনা বসাতে কোনো অসুবিধে থাকল না।
ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। এরা 'জেলা কালেক্টর' হিসেবে অভিহিত হন। জেলা কালেক্টর জমিদারদের কাজনা আদায়েরকাজ তত্ত্বাবধান করত। কমিটি অব সার্কিট বন্দোবস্তের কাজ ১৭৭২ সালের মধ্যে শেষ করে।
নতুন ইজারাদার বা জমিদাররা চড়া হারে খাজনা আদায় করতে মনোযোগী হয়। যারা চড়া দামে নিলামে এইসব ইজারা নিয়েছিলেন, তারা যে-পরিমাণ রাজস্ব আদায় করবেন বলে আশা করেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে পারেননি। ইজারাদাররা কোম্পানীকে নির্দিষ্ট অঙ্কের খাজনা আদায় করে দিতে পারেনি। তাদের জমিদারি নিলামে দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত স্থাবর অস্থাবর সকল সহায় সম্পত্তিও কেড়ে নেয়। এরপরও এই পুরনো জমিদারদের কয়েদখানায় ঢোকানো হয়। নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়।
পুরনো জমিদারদের কাছ থেকে নিলামে জমি কিনে নতুন জমিদার হয়ে বসে নবাবের চাকুরেরা, ব্যবসায়ীরা, সুদখোর মহাজনেরা– জমিদারদের দুর্নীতিবাজ নায়েব ধরনের আমলারা। ফলে তারা খাজনা আদায়ের বেলায় পুরনো জমিদারদের রেকর্ড ভেঙে ফেলে। প্রজাদের দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। লোকজন জায়গা জমি পালাতে থাকে। সে সময়ে লোকসংখ্যার তুলনায় অনাবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে বেড়ে যায়। বকেয়া খাজনার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তারাও কোম্পানীকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের ভাগ্যেও পুরনো জমিদারদের মতো সব হারিয়ে কয়েদখানায় যেতে হত।
এই সমস্যা নিরসনকল্প কোম্পানী দশশালা বন্দোবস্ত করে।
দশশালা বন্দোবস্ত
জমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারভিত্তিক জমিদারদের একটা সামাজিক স্বার্থ জড়িত ছিল যা অস্থায়ী ইজারাদারদের বেলায় ছিল না। তাই ধরে নেওয়া হয় যে, জমিদারদের তাদের পুরানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিলে ও তালুকের সম্পদ অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করা হলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় সহজতর হবে অপরদিকে তা কৃষককুলকেও ইজারাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের শর্তাবলীর কারণে এক্ষেত্রে সরকারের হাত বাঁধা ছিল। ১৭৮৯-১৭৯০ সালে লর্ড কর্নওয়ালিন জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। এর ফলে জমিদার ও তালুকদাররাই জমির প্রকৃত মালিক বলে বিবেচিত হন। তারা সরকারের কোনো অনুমতি ছাড়াই তাঁদের জমি দান বা বিক্রি করতে সক্ষম বা বন্ধক দিতে পারবেন। এমন কি উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করতে পারবেন। আর কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের জমিদাইর নিলামে দেওয়া হত। কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবস্তের মত তাদেরকে কয়েদ করা হত না।
রাজস্ব শাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কালেক্টরকে জেলার সর্বেসর্বা প্রশাসকে পরিণত করা হয়। কালেক্টরকে সকল নির্বাহী ও বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কেন্দ্রায়ন ও হস্তক্ষেপের প্রতীক রাজস্ব কমিটিকে বিলুপ্ত করে স্থাপন করা হয় রাজস্ব বোর্ড, যার দায়িত্ব হলো রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়াবলির সাধারণ বা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। জমিদারগণকে তাদের জমির ন্যায্য রাজস্ব নির্ধারণের জন্য এই কালেক্টরের মুখাপেক্ষী হতে হয়। রাজস্ব বোর্ডও রাষ্ট্রের রাজস্বের জন্য কালেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হয়। ১৭৮৬ সনের সংস্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত প্রশাসনিক বুনিয়াদ রচনা করে। সরকার তখন থেকে আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও দৃঢতার সঙ্গে জমিদারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
দশশালা বন্দোবস্তের সাফল্যের কারণে ১৭৯৩ সালে একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব প্রদানের পরেও বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ জমিদারদের হাতে রয়ে যেত। তারা প্রজাদের দফায় দফায় খাজনা বাড়িয়ে দিত। তারা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, অনাবাদি জমি নতুন করে বন্দোবস্ত দিত প্রজাদের কাছে। নতুন খাজনা ধার্য করত। এভাবে তাদের আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এটা কোম্পানী এবং জমিদারদের জন্য একটি সুবিধাজনক বন্দোবস্তে পরিণত হয়। আর প্রজারা নতুন শোষণের জাতাকলে পড়ে।
কেন এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
এ সময় কোম্পানীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাদের দরকার ছিল বিপুল অর্থ। তারা চেয়েছিল ভারতে তাদের ব্যবসাবানিজ্য বিনা মুলধনেই করবে। তারা প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ লুটপাট করে সেই অর্থ দিয়েই ভারতে ব্যবসাবানিজ্য চালাবে। সোজা কথায় বিনা পূঁজিতে মুনাফা কামানোর ধান্ধা। কিন্তু তাদের নিয়োগকৃত নাইবে নাজিম রেজাখানের দু:শাসন, দুর্ভিক্ষ, কোম্পানী লোকজনের উশঙ্খল আচরণ কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডারদের কিছুটা হতাশ করেছিল। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিপুল অর্থ কামাইয়ের ইচ্ছে ছিল তাদের। দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলায় তখন এত জনসংখ্যা ছিল না। এই অল্প মানুষকে সহজে সুলভে শোষণ করে খাজনা আদায়ে জন্যই কোম্পানী জমিদারী প্রথায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল।
ইংরেজরা কুটির শিল্প, হস্ত শিল্পকে শেষ করে দিয়েছিল। তখন কেবল আয় বলতে জমির খাজনাই ছিল প্রধান। জমিদার পাল্টাতো কিন্তু শোষিত প্রজারা পাল্টাতো না। বাবার বকেয়া খাজনা ছেলের কাঁধে বর্তাতো। ছেলের বকেয়া তার ছেলের কাধেঁ পড়ত। এভাবে বংশপরম্পরায় বকেয়া খাজনা প্রদানের দায় বহন করে যেত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মানে চিরস্থায়ী প্রজাশোষণ–
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার ফলে প্রজাদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে গেল। যো লোকটি জমি চাষ করছে, এতকাল জেনে এসেছে জমিটি তার—তার ইচ্ছেমত ফসল চাষ করছে, ছেলেপেলেদের জমি হস্তান্তর করতে পারছে, প্রয়োজনে বিক্রি করতে পারছে, জমি বন্দক দিয়ে ঋণ নিতে পারছে—এসবই এক খোঁচায় বন্ধ হয়ে গেল চিরস্থাযী বন্দোবস্তের কারণে। সবকিছু্রই মালিক হয়ে গেল জমিদার। জমিদার খাজনা আদায় ছাড়া আর কোনো বিনিয়োগই করছে না ফসলী জমিতে—না শ্রম, না পূঁজি—বিনা মূলধনেই কৃষককের ফসলের সিংহভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে। চাষী কোনো গাছপালা লাগাতে পারে না। কোনো গাছপালা কাটারও ক্ষমতা তার নেই। যেখানে সে থাকে, সেখানে যেনতেন প্রকারে ঘর বেঁধে থাকবে—কোনো পাকা ঘর তুলতে চাষীরা পারবে না। জমাজুতোও পরতে পারবে না। মেয়ের বিয়েতে খাজনা দিতে হবে। বাপমা মারা গেলে তার শ্রাদ্ধশান্তিতে খাজনা ছাড়া করা যাবে না। চাষীর ছেলে হলেও জমিদারকে খাজনা দাও। এমনকি কোনো ঊৎসব-পার্বনও খাজনা ছাড়া প্রজারা করতে পারবে না। রায়ত বা প্রজারা এক ধরনের শেকলেবন্দী শ্রমিক জীবনের অধিকারী হল পাঁচশালা বন্দোবস্তের মাধ্যমে।
এই শেকল আরও শক্ত হয়ে যেত মহাজনদের ফাঁদে পড়লে। সাধারণত দেশে তখন বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষ-মহামারী লেগেই থাকত। আর এই মেয়ের বিয়ে, বাপের শ্রাদ্ধ আর ছেলের জন্মের কারণে খাজনা দেওয়ার উপায় থাকত না। ফলে চাষীরা মহাজনদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হার সুদে ঋণ নিতে হত। এই ঋণ কখনো ফেরত দেওয়া কখনো ফুরাতো না। বাপের ঋণ শুধতে হত ছেলেকে। ছেলের ঋণ নাতিকে। এইভাবে মহাজানের ঋণের শেকড় বংশপরম্পরায় বহন করতে হত। আবার চাষী যদি অক্ষরজ্ঞানহীন মুর্খ কিসিমের হত, তাহলে কায়দা করে একই ঋণের টাকা পয়সা দুই-তিনবারও আদায় করা হত।
এই মহাজনদের বড় বড় ব্যবসাপাতিও ছিল। তারা ফসল ওঠার সময়ে জমি থেকেই তাদের ঋণের টাকা আদায় করত। সেই সময়ে ফসলের বাজার মূল্য কম থাকত। ফলে মহাজনরা কম টাকায় বেশি ফসল পেয়ে যেত। চাষীরা আরও বেশি ঠকত। কখনো এই সুদের কারবারীরা হত বড় কৃষক। তাদের বলা হত জোতদার। তারা সব সময়ই হা করে থাকত ক্ষুদে কৃষকের জমিজিরতের গিলে খাওয়ার জন্য।
জমিদাররা খালসা বা রাজ কোষাগারে আদায়কৃত খাজনার ধার্যকৃত অংশ জমা দেওয়ার পরেও তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ থেকে যেত। এই অর্থ সম্পদ দিয়ে তারা এক ধরনের আয়েসী জীবন যাপন শুরু করে। তারা তাদের জমিদারিকে ছোটো ছোটো অংশ ভাগ করে পত্তনিদার বা তালুকদারদের কাছে ইজারা দিতেন। এই পত্তনীদাররা বা তালুকদাররা আসলে জমিদারের আমলা। জমিদাররা তাদের উপর জমিদারির ভার দিয়ে কোলকাতায় বসবাস করত। তালুকদাররা তখন প্রজাদের লুটে পুটে খেত। আদায় করত ইচ্ছেমত খাজনা। দখল করত সহায় সম্পত্তি। প্রজারা এর প্রতিকার কারও কাছে পেত না। আসল জমিদারের কাছে প্রজারা পৌঁছুতেই পারত না। আর যদি কেউ আদালতে যেত—তাহলে সেখানে উকিল নামের কুমীরের খপ্পরে পড়ত। এই জমিদারীকাল ছিল প্রজাদের জন্য দোজখ।
চতুর্থ পর্ব——————————————–
প্যাগোডা ট্রি ওরফে টাকার গাছের কাহিনী
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ইংলণ্ড থেকে যে সব ইংরেজরা ভারতে আসত তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র, ছিচকে, গুণ্ডা, মারকুটে ছিন্নমূল, আশিক্ষিত, অভদ্র। এদের অনেকের বাপদাদার ঠিক ঠিকানা ছিল না। এরা কলকাতায় এলে কিছুদিন ঘুরে বেড়াত ফ্যা ফ্যা করে। তারপর জুটে যেত কোম্পানীর চাকরী। বেতন বার্ষিক মাত্র পাঁচ পাউন্ড। সবশেষে বার্ষিক চল্লিশ পাউন্ড। এই বেতনে মেসের ভাড়াই হত না। এরা কোনোক্রমে সই করতে জানত, অথবা সামান্য লেখাপড়া—কিছু সহজ সরল অংক জানত। এরা লক্ষ লক্ষ পাউন্ডের মালিক হয়েছে কয়েক বছরের মধ্যেই। এই ধনলাভের কাহিনী বাংলার মানুষকে লুটপাটেরই ইতিহাস। তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। কলাগাছ থেকে বটগাছ। তারপর পুরো বন। ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পরে বাংলাকে ইংরেজ বেনিয়ারা প্যাগোডা ট্রি বা টাকার গাছে পরিণত করেছিল।
এই ইংরেজরা বাংলাকে শোষণ করে ছিবড়ে করে ফেলে হয়েছিল নবাব। নবাব মানে খুব ধনশালী ব্যক্তি। এরা ভারতে প্রভুত অর্থ সংগ্রহ করে ইংলন্ডে ফরে যায়। বিত্তশালী জীবন যাপন করে।
সিরাজউদ্দৌলার পতনের পরে মীর জাফরের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকা পয়সা এইসব ভাগ্যবান ইংরেজরা। লর্ড ক্লাইভ ট্রেজারি লুট করেছিলেন। তিনি সেখান থেকে নিয়েছিলেন দেড় মিলিয়ন স্টারলিং মূল্যের নগদ টাকা, সোনা, রূপা, গহনাপাতি, এবং বহু মুল্যবান জিনিসপত্রাদি। মীর জাফরকে নবাব করা হলে তিনি ক্লাইভকে যা খুশি সম্পদ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। ক্লাইভ নিয়েছিলেন এক লক্ষ ষাট হাজার পাউন্ড। তিনি অর্ধ মিলিয়ন বিলিয়েছিলেন তার অধীনস্ত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে। এরা কোম্পানীর বাহিনী। আর যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানীর লোকদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল ২৪০০০ পাউন্ড।
মীর জাফর কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাগ্যবানদের তালিকা—
গভর্নর ড্রেক—৩১,৫০০ পাউন্ড, লর্ড ক্লাইভ—২,১১, ৫০০ পাউন্ড, মিঃ ওয়াটসন—১,১৭,০০০ পাউন্ড, কিল প্যাট্রিক—৬০,৭৫০ পাউন্ড, মিঃ ম্যানিংহাম—২৭,০০০ পাউন্ড, মিঃ বিচার—২৭,০০০ পাউন্ড, মিঃ বোডম—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ ফ্রাঙ্কল্যান্ড—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ ম্যাকেট—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ আ্যামিয়েট—১১,৩৬৬ পাউন্ড, মিঃ পার্কেস—১১,৩৬৬ পাউন্ড, মিঃ ওয়ালশ—৫৬,২৫০ পাউন্ড, মিঃ স্ক্রাপটন—২২,৫০০ পাউন্ড, মিঃ ল্যাসংটন—৫৬২৫ পাউন্ড, মেজর গ্রান্ট—১১২৫০ পাউন্ড।
ইংরেজের বিজয় উপলক্ষ্যে কিছু বাঙালিবাবুও পুরস্কৃত হয়েছিলেন। একে পুরস্কার না বলে ক্ষতিপূরণ নাম দেওয়া হয়েছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণি ঠাকুর পেয়েছিলেন মীরজাফরের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ হিসাবে—১৩,০০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে কোলকাতা গ্রামের পাথুরিয়াঘাটা পাড়ার জমি কিনে ভিটে তোলেন। সেখানে পরবর্তি সময়ে একঘর পাথুরিঘাটের জমিদারদের পত্তন হয়।
মীর জাফরকে সরিয়ে মীরকাশেমকে ১৭৬০ সালে পুতুল নবাব হিসেবে কোম্পানী বাংলার গদিতে বসায়। সে উপলক্ষ্যেও বিস্তর পুরস্কার জুটেছিল এই পরদেশী লুটেরাদের। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা—গভর্নর ভ্যানসিটার্ট—৫৮,৩৩৩ পাউন্ড, মিঃ হলওয়েল—৩০,৯৩৭ পাউন্ড, মিঃ সুমনার—২৮০০০ পাউন্ড, জেনারেল কাইলাইড—২২ম৯২৬ পাউন্ড, মিঃ ম্যাকগুইরি—২২,৯১৬ পাউন্ড, মিঃ স্মিথ—১৫, ৩৫৪ পাউন্ড, মিঃ ইয়র্ক—১৫, ৩৫৪ পাউন্ড।
১৯৬৪-৬৫ সালে মীরকাশেমকে সরিয়ে নরমপন্থী নিজামউদ্দৌলাকে গদিতে বসানে হলে আবারও পুরস্কার পায় মেজর মনরো—১৩০০০ পাউন্ড, তার অধীনস্ত সাহবরা পেল আরও ৩০০০ পাউন্ড করে পুরস্কার। আরও অনেকে পেয়েছে। দাগি মুদ্রারাক্ষস লর্ড ক্লাইভ পেয়েছিলেন—৫৮,৬৬৬ পাউন্ড।
মুর্শিদাবাদের নবাবদের কাছ থেকে এই পুরস্কার আদায়ের টাকাটা আসমান থেকে আসেনি। এই টাকাটা বাংলার প্রজাদেরই টাকা। অভাবী ভুখা নাঙ্গা প্রজাদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়েছিল। তাদের রক্ত শোষণ করে অর্জন করেছিল জমিদার, তালুকদার, গাত্তিদাররা। তারা জমা দিয়েছিলেন রাজকোষে। সেখান থেকে ইংরেজরা নিয়েছে।
Prosperous Britis India নামে একটি বই লিখেছিলেন মিঃ ডিগবি। তিনি লিখেছেন—পলাশী এবং ওয়ার্টারলুর যুদ্ধের মধ্যবর্তি সময়ে ভারত থেকে ইংলন্ডে অন্তত ১০ কেটি পাউন্ড নগদ অর্থ চলে গিয়েছিল। The Law of Civilization and Decay নামে আরেকটি বই লিখেছেন ব্রুকস এডামস। তিনি বলেছেন— শিল্পবিপ্লব কার্যত শুরু হয় ১৭৬০ সালে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সোনা-রূপা ইংলন্ডে পৌঁছানোর পরে।
আর সে সময়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষে মানুষ গরু-জরু বেঁচে দিচ্ছে। গাছের পাতা-ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। না খেতে পেয়ে তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে। তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ খাজনা দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে বাঘের পেটে যাচ্ছে। বাকীদের পিঠের চামড়া তুলে খাজনা আদায় করে এইসব ইংরেজ লুটেরাদের পকেটে ভরে দেওয়া হচ্ছে।
১৭৮২ সালে ইংলন্ডে পৌঁছে মেজর জন স্কট ওয়ারেন হেস্টংইসকে একটি চিঠিতে লিখছেন—আমাদের ব্যবসার হয়তো মন্দা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আজকের মতো এমন বিপুল বৈভব বোধহয় এই রাজ্যে কখনো ছিল না। আমি ২০০ সোনার মোহর গলাতে দিয়েছিলাম একজনকে, তিনি জানালেন গত বারো বছর তিনি অন্তত দেড় টন সোনার মোহর এবং প্যাগোডা গলিয়ে 'বার' তেরি করে দিয়েছেন। তার মানে প্রতি বছর গড়ে ইংলন্ডে মজুত হয়েছে ১৫০ হাজার পাউন্ড।
কেউ কেউ আবার সে সময় বাংলা থেকে ইংলন্ডে হীরেও নিয়ে যেত। হীরের আমদানি এত বেড়ে গিয়েছিল যে তখন ইউরোপের বাজারে হীরার দাম পড়ে গিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসপত্নী কোনো পার্টিতে তিরিশ হাজার পাউন্ডের গহনা পরে যেতেন। এই টাকা বাংলার মানুষের টাকা।
১৭৬৯ সালে বাংলাকে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয়। প্রত্যেক জেলায় একজন করে সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। এই পদটিই ১৭৭২ সালে কালেক্টারে রূপান্তরিত করা হয়। এই জেলার কালেক্টারদের প্রধান কাজই ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া। কেউ কেউ এরা সুদের ব্যবসা করতেন। কেই কেউ দুনম্বরী ব্যবসাবানিজ্য। জন বাথো নামে বর্ধমানের এক কালেক্টার দেশী একজন জমিদারকে লবণের ব্যবসা পাইয়ে দেন বার্ষিক আটাশ হাজার পাউন্ড ঘুষের বিনিময়ে। শ্রীহট্টের কালেক্টার কোম্পানীর কাছে হাতির ব্যবসা করে অনেক টাকা রোজগার করেছেন।
ক্লাইভ আঠার বছর বয়সে ভারতে এসেছিলেন। তিনি চাকরী পেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে একজন রাইটার বা কেরানী হিসেবে। পরে প্রতিভাবলে কোম্পানীর উচ্চপদে চলে যান। হয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল। সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর পরে ১৭৬০ সালে ক্লাইভ যখন ইংলন্ডে ফিরে যান তখন সঙ্গে নিয়েছিলেন তিন লক্ষ পাউন্ড। ভারত থেকে তার জমি সম্পত্তির আয় থেকে বার্ষিক আয় ছিল ২৭০০০ পাউন্ড। সে সময়ে তার বার্ষিক আয় ছিল ৪০০০০ পাউন্ড।
এই ইংরেজরা তখন হয়েছিলেন নবাব। এইরকম একজন নবাবের নাম হল—মিঃ হিকি। উইলিয়াম ম্যাকিনটস হিকির দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে লিখেছেন– সকাল সাতটা নাগাদ দারোয়ান নবাববাহাদুরের গেট খুলে দিল। নিমেষে বারান্দাটি সলিসিটার, রাইটার, সরকার, পিওন, হরকরা, চোপদার, হুক-বরদার ইত্যাদিতে ভরে গেল। বেলা আটটায় হেড বেয়ারা এবং জমাদার প্রভুর শোয়ার ঘরে প্রবেশ করবে। একটি মহিলাকে তখন শয্যাত্যাগ করে একান্তে প্রাইভেট সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে দেখা যাবে,–অথবা বাড়ির অঙ্গন পরিত্যাগ। নবাব বাহাদুর খাট থেকে মাটিতে পা রাখামাত্র অপেক্ষমান ভৃত্যবহর তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকে পড়বে। তারা আনত মাথায় পিঠ বাঁকিয়ে প্রত্যেকে তিনবার তাঁকে সেলাম জানাবে। ওদের হাতের একদিক তখন কপাল স্পর্শ করবে, উল্টো দিকটা থাকবে মেঝেতে। তিনি মাথা নেড়ে অথবা দৃষ্টিদানে তাদের উপস্থিতিকে স্বীকৃতি জানাবেন।
পারসিভাল স্পিয়ার একটি বই লিখেছেন—The Nababs নামে। বইটিতে কয়েকজন মৃত লুটেরা নবাব সাহেবের রেখে যাওয়া অস্থাবর সম্পত্তির বিববরণ আছে। তার মধ্যে নিকোলাসের ঘরে পাওয়া যায় রাশি রাশি দামি আসবাব। বেশ কিছু ঘড়ি, আয়না, লণ্ঠন, রকমারি পালকি, বিপুল সংখ্যক বাসনপত্র, চা, কফি, পান, তামাকের বিবিধ সরঞ্জাম, বিভিন্ন মদের বোতল এবং আরও অনেক কিছু। তার মালসামানের জন্য ছিল পাঁচটি গুদাম। বারওয়েল নামের একজন নবাবের খাওয়ার সময় উপস্থিত থাকত প্রাতঃরাসের সময় তিরিশজন, মধ্যাহ্ণভোজের সময় পঞ্চাশজন এবং রাত্রির খাওয়ার সময়ে অগণিত। খেয়ে দেয়ে মধ্যরাত্র অবধি নাচের আসর হত। ভোর পর্যন্ত মদ্যপান।
হিকি নামে একজন নবাব ১৭৯৬ সালে গভর্নরের বাড়ির পাশেই পার্কের গা ঘেষে নদী পড়ে একটি প্রাসাদতুল্য বাংলো তৈরি করেছিলেন মাত্র ছয়মাসের মধ্যে। তার আর্কিটেক্ট আর মিস্ত্রিরা ছিল পশ্চিমি। কলকাতার চূঁচুড়ার এই বাংলোটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন তার রক্ষিতা এক জমাদারনিকে। তার খরচ পড়েছিল চল্লিশ হাজার টাকা। হিকির বউ শার্লট যখন মারা গেল তখন হিকির জন্য কাজ করত তেষট্টিজন ভৃত্য।
এরকম রাশি রাশি নবাব তখন কোলকাতায় ছিলেন। তারা বাংলাকে লুটপাট করেছেন। এদের লুটপাটের অর্থের অন্যতম যোগানদাতা ছিলেন স্থানীয় বাবুশ্রেণী, জমিদার।
এই নবাবদের ইংলন্ডের সমাজে ভাল চোখে দেখ হত না। তাদের মন্তব্য হল– এরা সবাই হয় দারোয়ান-তনয় অথবা দাসীপুত্র। হৃদয়হীন এই পাষণ্ডের দল প্রত্যেকই হাজার হাজার নেটিভের হত্যাকারী। হিন্দুস্থানে তাঁদের কেউ একশো নিরীহ মানুষ খুন করে এসেছেন—কেউ বা পঞ্চাশ হাজার। এদের দিকে তাকানোও পাপ।
তারা বাংলা থেকে লুটপাট করা অর্থ দিয়ে ইংলণ্ডে কাটিয়েছেন বিলাসবহুল জীবন। টাকা পয়সা দিয়ে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৪ সালে এরকম ৩০জন নবাব পার্লামেন্টের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। এদের সম্পর্কে একজন লিখেছেন—লজ্জার কথা সেদিন জনৈক নবাব এক ভদ্রসম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন একজন রূপোজীবিনীকে। অন্য একজন লিখেছেন—সাবধান, কোনও ভদ্রমহিলা যেন ভুলেও কখনও কোনও নবাবের সঙ্গে না নাচেন। তাদের নবাব তখন দাস-ব্যবসায়ী. ওয়েস্ট ইন্ডিজের খামার মালিকের চেয়েও ঘৃণ্য এক অসামাজিক জীব। তারা ভালো বাড়ি কেনে, ভালো খায়, যত খায় তার চেয়ে বেশি অপচয় করে, ছড়ায়। তারা ডুয়েল লড়ে, জুয়া খেলে,–মাত্রাহীন বিলাসে গা এলিয়ে দিয়ে ভদ্রসমাজকে ব্যঙ্গ করে। *
লেখাসূত্র : ১. রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ: ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায় : http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=18247
গ্রন্থসূত্র :
১. ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক : শ্রীপান্থ
২. হাজার বছরের বাঙ্গালী : গোলাম মুরশিদ
৩. ভারত-সন্ধানে : জহরলাল নেহেরু
৪. The Nabobs : Percival Spear
৫. The Annals of Rural Bengal : W W Hunter
পঞ্চম পর্ব———————————————————
একটু ইংরেজদের গেড়ে বসার আদিকাণ্ড–
সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে মুগল সম্রাটের কাছ থেকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সুরাটে একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি লাভ করে। কয়েক বছর পরে তারা দক্ষিণ ভারতে একখণ্ড জমি কিনে মাদ্রাজ শহর পত্তন করে। ১৬৬২ সালে ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পোর্তুগালের কাছ থেকে বোম্বাই দ্বীপটি বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন। তিনি কোম্পানীর কাছে এই দ্বীপটি হস্তান্তরিত করেন। ১৬৯০ সালে কোলকাতা শহর জোব চার্নক নামে এক ইংরেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ইংরেজ তারা আস্তানা গাড়ে। সমুদ্রের উপকূলে কয়েকটি ঘাঁটি বসায়। ক্রমে ক্রমে তারা দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরে বিস্তির্ণ ভূখণ্ড ইংরেজদের দখলে আসে। কয়েক বছরের মধ্যে তারা বাংলা, বিহার ও উড়িশ্যা দখল করে বসে। এবং সমগ্র পূর্ব-উপকূলে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।
এর চল্লিশ বছর পর, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে তারা একবারে দিল্লীর তোরণদ্বারে হানা দেয়। ১৮১৮ সালে মারাঠাদের পরাজিত করে। ১৮৪৯ সালে শিখ-যুদ্ধের পর ইংরেজ সারা ভারতবর্ষে কায়েম হয়ে বসে।
মধ্যবিত্তের উত্থান
ইংরেজ শাসনে জমিদারদের প্রজাশোষণে লোকজন অনাহারে অত্যাচারে মারা গিয়েছে। অনেকে সব ছেড়ে ছুড়ে অন্য জমিদারের পরগণায় আশ্রয় নিয়েছে। আর যারা বনেজঙ্গলে পালিয়েছে তারা বাঘের আর কুমিরের পেটে গিয়েছে। অনেক নতুন নতুন জমিদার পুরনো জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারী কিনে নতুন খাজনার হার ধার্য করেছে। এর মধ্যে অনেক প্রজা কখনো কখনো রুখেও দাড়িয়েছে। ১৮৭৩ সালে পাবনাতে নাটরের জমিদারি ভেঙে পাঁচজন ধনী লোক জমিদার কিনে যখন খাজনা বাড়াতে চেয়েছিল তখন প্রজাদের সঙ্গে জমিদারদের বড় ধরনের রায়ট হয়েছিল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ২০ বছরের মধ্যে রাজস্ব দিতে না পারার জন্য তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি পুরনো জমিদাররা জমিদারী খুইয়েছিলেন। এসব জমিদারি এসেছে নব্য ধনীদের মধ্যে। তখন ব্যবসার চেয়ে জমিদারদের সামাজিক মর্যাদা বেশি ছিল। কিন্তু এইসব জমিদাররা নিজেরা কখনো জমিদারি পরিচালনা করেননি। তারা অন্য লোকদের দিয়ে জমিদারি পরিচালনা করেছেন। তারা হয়েছেন অনুপস্থিত জমিদার।
হেস্টিংসের আমলে গোড়ার দিকে জমিদারের সংখ্যা মাত্র শ খানেক, সেখানে ১৮৭২-৭৩ সালে এই সংখ্যা দাড়ায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ২ শোতে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার জমিদারের সম্পত্তি ছিল মাথা পিছু ৫০০ একরেরও কম।
জমিদার এবং মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রজাদের খাজনা দিতে হয়েছে বেশি। ১৭৭২ সালে রাজস্ব আদায় হয়েছিল তিন কোটি টাকা, কিন্তু একশো বছর পরে ১৮৭২ সালে জমিদার এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা রাজস্ব আদায় করতেন ১৭-১৮ কোটি টাকা।
বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্যই ছিল ভারতে জমিদার, তালুকদার, জোদ্দার, ধনী কৃষক সৃষ্টি করে একটি অনুগত শ্রেণী সৃষ্টি করা। তাদের শোষণে যদি কখনো প্রজাবিদ্রোহ হয়, তাহলে এই অনুগত বাহিনীই প্রজাদের বিদ্রোহ থেকে তাদের বাঁচাবে। তাদের ব্যবসা-বানিজ্য-শোষণ কৌশল টিকে থাকবে। এদের পাশাপাশি বিশেষভাবে রাজভক্ত বা অনুগত প্রজাদেরও তাদের কোম্পানীতে, ব্যবসাবানিজ্যে, জমিদারী-সেরেস্তায় কিছু দায়িত্বজনক পদ দিয়ে জমিদারি পরিচালনার কাজ পাইয়ে দেয়। এভাবে কিছু ধনীক শ্রেণীও ইংরেজরা তৈরি করল।দেশে পরজীবী একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হল ইংরেজ আমলে।
বেহাল কৃষি ব্যবস্থা
ইংরেজদের আগমণের আগে বাংলার শুধুমাত্র অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিল না। দেশে শিল্পী দক্ষ কারিগরী পেশায় লোকের সংখ্যা ছিল প্রচুর। সে সময় মানুষের বড় ধরনের শিল্প না থাকলেও ঘরে ঘরে ক্ষুদ্র শিল্প-কুটির শিল্প ছিল। সেখানে কাজ করতে করতে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষজন সেই কাজে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিল। তারা পরিচিত হয়েছিল—তাঁতী বা জোলা, কামার, কুমোর, সুতোর ইত্যাদি নামে। চাষীরাও সে সময় চাষের অবসরে বা ফাঁকে ফাঁকে এইসব কুটির শিল্পে কাজ পেত এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ ঘটত তাদের। ফলে দেশে মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না।
এই গ্রামবাংলার ঘরে উৎপাদিত মসলিন কাপড়ের খ্যাতি তখন শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বজোড়া। বিদেশীরা মসলিন কিনতে ভারতে আসত। বাংলা থেকে তা কিনে উচ্চদামে ইউরোপে বিক্রি করত। তারা খুঁজে বের করত কোথায় এই মসলিন উৎপাদিত হয়। শোনা যায় কলম্বাসও এই মসলিনের খোজেই ভারত আবিষ্কারের জন্য অভিযান চালিয়েছিলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে আসার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের নানাপ্রকার শিল্পজাত দ্রব্য, শাল, মসলিনজাতীয় বস্ত্র ও নানাবিধ মসলা প্রভৃতি প্রাচ্য দেশ থেকে পাশ্চাত্যে চালান করা। সে সময়ে ইউরোপে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। বাংলায় যখন কোম্পানীর শাসন জেঁকে বসেছে—লুটপাটের টাকায় ইংলণ্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে তখন ইংলন্ডের একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা দাবী করে বসে ইংলন্ডের শিল্পবাজার প্রসারের জন্য ভারত থেকে পণ্য আমদানী বন্ধ করে দিতে হবে। বৃটিশ পার্লামেন্ট সে দাবী মেনে নেয়।
তখন ভারতের বহির্বানিজ্য সম্পূর্ণভাবে কোম্পানী নিয়ন্ত্রণে থাকায় ভারত থেকে পণ্য ইউরোপের অন্য দেশেও প্রবেশাধিকারের সুযোগ হারাল। ইংলণ্ডে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ভারতে একচেটিয়াভাবে আসা শুরু করল। একই সঙ্গে বাংলা তথা ভারতের পণ্যের উপরে কোম্পানী চড়া কর বসিয়ে দিল। ফলে ইংলণ্ডের পণ্য কম দামে বাজারে পাওয়া যেতে লাগল। এইভাবে দেশী পণ্যের বাজার পড়ে গেল। দেশী পণ্য একই সঙ্গে দেশী ও বিদেশী বাজার হারাল। ফলে দেশের শিল্প খাতটি সমূলে ধ্বংস হয়ে গেল। জহর লাল নেহেরু বলেছেন—উনিশ শতকের ভারত ইতিহাস হল ধ্বংসপর্বের ইতিহাস–পুরাতন শিল্পাদি নিশ্চিহ্ণ করার ইতিহাস। জাহাজী কারবার কাজ, বস্ত্র শিল্প, ধাতব পদার্থের কাজ, কাঁচ তৈরির কাজ, কাগজ তৈরির কাজ—আরও অনেক শিল্প মৃত্যুমুখে পতিত হল।
ভারতের শিল্পোন্নতি যাতে না হয়, যাতে শিল্পের দিক থেকে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ অবনতিলাভ করে—সেদিকেই ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল বেশি। যন্ত্রপাতি ভারতে যাতে না আসতে পারে তার জন্য নিয়ম করা হল। বাজারে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হল যে বৃটিশ পণ্য না হলে যেন ভারতের না চলে। ইংলন্ড দ্রুত তার শিল্পোন্নতির দিকে এগিয়ে চলল, ভারত হয়ে গেল কৃষিনির্ভর দেশ। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে শতকরা পঞ্চান্ন লোক এদেশে কৃষিদ্বরা জীবিকানির্বাহ করত। ইংরেজদের এই শিল্পধ্বংসের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কৃষিজীবিীর সংক্যা বেড়ে দাড়িয়েছির শতকরা চুয়াত্তর জন। এদেশ থেকে সস্তায় কাঁচা মাল ইংরন্ডের কারখানায় চলে গেল এবং বিলেতের কারখানাজাত শিল্পসম্ভার এই দেশের বাজারই চড়া মূল্য বিক্রি হতে লাগল। ইংরেজদের প্রধান কেন্দ্র বাংলা হওয়ায় বাংলার অবস্থাই সবচেয়ে করুণ হয়ে পড়ল।
ভারত-ইতাহাসের যুগ্ম লেখক এডওয়ার্ড টমসন ও জি.টি. গ্যারেট লিখেছেন, ইংরেজদের ঐশ্বর্য্যলিপ্সা একটা যেন রোগের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ-বিষয়ে তারা কোর্টেস ও পিৎসারোর আমলের স্প্যানিশদের পর্যন্ত হার মানিয়েছিল। একেবারে নিঃশেষে শোষিত না হওয়া পর্যন্ত এই বাংলাদেশের আর শান্তি ছিল না।
ভূমিহীন ও বর্গাচাষীর বেত্তান্ত
ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সুকৌশলে বাংলার এই কুটির শিল্পকে পুরোপুরি ধ্বংশ করে দেয়। ফলে এই কুটির শিল্পে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ শিল্পী ও কারিগররা আত্মহত্যা করে– মরে যায়। ১৮৩৪ সালে বড়লাট লর্ড বেন্টিংক তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন—ব্যবসা বানিজ্যের ইতিহাসে এই রকম দুরাবস্থার তুলনা খুবই কম মেলে। সমগ্র ভারত ভূখণ্ড তাঁতি জোলা সম্প্রদায়ের অস্থি-কঙ্কালে পরিকীর্ণ হয়ে আছে।
এদের কাজ ছিল না, উপজীবিকা ছিল না, বহু বংশপরম্পরায় অর্জিত দক্ষতা বা শিল্পকুশলতাও কাজের অভাবে নষ্ট হয়ে গেল। বেঁচে থাকার জন্য তারা তখন কৃষিকাজের দিকে ছুটে আসে। ফলে এরা জমির উপর বিরাট ভারস্বরূপ হয়ে দাঁড়াল। তারা পরিণত হয় ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে। কেউ কেউ হল বর্গা চাষী। এদের জীবন ছিল মানবেতর। সভ্যজগতে যাকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা বলে তার বহু নিচের স্তরে লোকে কোনোমতে প্রাণধারণ করতে লাগল। এরা পরের জমিতে কাজ করে—হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে ফসল উৎপাদন করে। কিন্তু ফসলের উপরে তাদের অধিকার নেই। তাদের আয় খুবই কম। বর্গচাষীদেরকে জমির মালিকরা ভয়ঙ্কর জটিল পদ্ধতিতে জমি ভাড়া দেওয়া শুরু করে। মালিকরা জমি ভাড়া দেওয়া ছাড়া জমিতে আর কোনো পূঁজি বিনিয়োগ না করেই বর্গাচাষীর কাছ থেকে ফসলের বড় ভাগ পায়।
ভূমিহীন ক্ষেতমজুর আর বর্গাচাষীরা হয়ে উঠে দাসশ্রমিকের মত। তার সঙ্গে মহাজনদের কবলে পড়ে এই দাসজীবনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। প্রজাদের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যেতে লাগল। এইভাবে হাত বদলানোয় জমিগুলি দিন দিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরোয় পরিণত হয়ে এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি করল। কৃষকরা ঋণের ফাঁদে পড়ে মহাজনদের কাছে বেঁচে দিতে বাধ্য হল। ক্ষুদ্র কৃসকদের জমি গিলে নতুন নতুন ভূস্বামী সৃষ্ট হল। পরিচিত হল বাবুতে। ভূমিহীন শ্রমজীবীদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ বেড়ে উঠল।
ক্ষুদ্র কৃষক-ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জন্য তৎকালীন সরকারও কিছু করে নাই। পরবর্তিতে যখন রাজনীতিবিদদের উত্থান হল—তারাও তাদের জন্য কিছু ভাবে নাই।
জমির আয় খুব লাভজনক ও সম্মানজনক বলে তখন শিক্ষিতবাবুরা এবং ব্যবসায়ীরা জমি কিনে ভাড়া দিতে শুরু করল। এইসব জমির মালিকরা পরজীবী শ্রেণী সমাজে নতুন করে শোষক হিসেবে আর্বিভূত হয়।
ষষ্ঠ পর্ব————————————————
বাবুরাম সাপুড়ে
কোথা যাস বাপুরে।।
নববাবুবিলাস সম্বাদ
১৮৭২ সালে প্রথম যখন আদম শুমারী হয়। সেখানে দেখা যায়—সত্তরের মন্বন্তরের ক্ষতি পূরণ হতে প্রায় একশ বছর সময় লেগেছিল। দুই তৃতীয়াংশ লোকই হয় মরে গিয়েছিল—নয় পালিয়ে গিয়েছিল, ফলে প্রথম দিকে জমির পরিমাণ ছিল প্রচুর। কিন্তু চাষের লোক ছিল খুবই কম। যারা ছিল তারা জমিদারের শোষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শস্যচাষে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। ইংরেজরা বাংলা দখল করার পরে দেশে অসংখ্য ক্ষুদে সামন্ত বা জমিদার এবং বরগা চাষীর সৃষ্টি হয়। এর আগে মধ্যবিত্ত বলে কোনো সম্প্রদায় ছিল না।
তখন দেশটি পুরোপুরি বৃটিশদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। মাত্র ১০-১৫ জন বৃটিশ লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের উপর ছড়ি ঘোরাত। এই ছড়ি ঘোরানোর কাজটি করা হত স্থানীয় অনুগত শ্রেণীর লোকদের সহায়তায়। এই অনুগত বাহিনী সৃষ্টি করার জন্য ইংরেজরা ইংরেজি শিক্ষা চালু করে। বাঙ্গালী বাবুরাই ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে আসে। তারা ইংরেজি শিখে সাহেবদের দোভাষী, মুনশি, দেওয়ান ইত্যাদি কাজে ভিড়ে যেত। তাদের এই ভিড়ে যাওয়াকে বলা হয় সাহেব ধরা। সাহেবরা চাকরী, দুর্নীতি, ব্যবস্যা-বানিজ্য, জমিদারি, নবাবীর নামে যেসব লুণ্ঠন করত এইসব বাঙ্গালী বাবুরা তাদের সহযোগী হিসাবে বেশ বড় অঙ্কের বেতন পেত—বখরা পেত। এভাবে দেশে তখন নতুন ধরনের শিক্ষিত ধনীক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। তারা এইসব টাকা পয়সা দিয়ে নানা ধরনের ব্যবসা-বানিজ্য করেছে। জমিদারীও কিনেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার এক দশকের মধ্যেই কোলকাতায় থেকে নতুন ধরনের শোষক বাবু শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এরাই পুরনো জমিদারদের হটিয়ে আরও হৃদয়হীন জমিদারে পরিণত হয়েছে।
এই শিক্ষিত বাবুরা একটু ইংরেজি শিখেই সাহেব ধরতে শিখত। বাবুরা কোলকাতায় বনবাস করত। কোলকাতা শুরুতে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পন্য আমদান-রপ্তানীর কেন্দ্র। ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পরপরই কোলকাতাকে সারা ভারতের রাজধানী করা হয়। হয়ে ওঠে বৈদেশিক বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। ইংলল্ড থেকে তখন ভাগ্যান্বেষণে ইংরেজরা কোলকাতায় আসত। এই ইংরেজরা বাংলা ভাষা জানত না। এই মধ্যবিত্ত বাবুরা তাদেরকে জাহাজঘাটা থেকেই পাকড়াও করত। তারা সাহেবদের কেরানীর চাকরী করত। আবার কিছু কিছু বাঙালিরা ইংরেজী জানত না। কিন্তু দেখে দেখে কোম্পানীর দলিলপত্রাদি না বুঝেই হুবহু নকল করতে পারত। এদের নাম ছিল মুনশী। এরাই আবার প্রমোশন পেয়ে দেওয়ান হত। এরা নানা কায়দায় বেতনসহ নজরানা দস্তুরী আদায় করত ইংরেজদের কাছ থেকে। এভাবে তারা বেশ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসা বানিজ্য খুলেছিল। কেউ কেউ জমিদারও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ জয়রাম ছিলেন ইংরেজদের এ ধরনের ঠিকাদার। হয়েছিলেন হুইলার সাহেবের দেওয়ান। রামমোহন রায়ও ছিলেন কোম্পানীর সেরেস্তাদার—পরে দেওয়ান।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আদি সহযোগীর অন্যতম ছিলেন শোভারাম বসাক। ১৭৮০ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তার সম্পত্তির পরিমাণ—কোলকাতার বগবাজার এলাকায় ৩৭টি বাড়ি, কৌরকাতার বিভিন্ন এলাকায় ৩টি বাগান ও পুকুর। মারা যাওয়ার পরে তার গুদামে ছিল নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ কাপড়, ৫ মন রকমারি মশলা, ১৮ মন আফিং, এবং পরিমাণমত চন্দনকাঠ, তামা, সিসা, লবঙ্গ, ফিটকিরি ইত্যাদি। সিন্দুকে ছিল ৮৯১টি মুক্তা—এর মধ্যে ৬১টি আবার আকারে বেশ বড়, ৪১৩টি হিরা, ৩৫টি পদ্মরাগ মণি। তাছাড়া অনেক মোহর, সোনার ছড়া ইত্যাদি। সাহেবদেরও তিনি টাকা সুদে ধার দিতেন। তাদের কাছে তার পাওনা ছিল ৫ লক্ষ ২৭ হাজার ১১২ টাকা। দেশীয় লোকদের কাছে পাওনা ৫৩ হাজার ৮৩ টাকা। সুয়েজ, বোম্বাই এবং বসরার বণিকদের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৭৫১ টাকা। এ ছাড়াও মালদা, কাশিমবাজার, হরিয়াল, ক্সীরপাই ও ঘাটালে শোভারাম বসাকের নিজস্ব আড়ং ছিল।
লুণ্ঠনপর্বের শুরুতেই ইংরেজ কোম্পানী জাহাজে করে এদেশ থেকে মালপত্র ইংলন্ডে নিয়ে যেত। ফেরার পথে খালি জাহাজ নিয়ে আসার কিছু সমস্যা ছিল। ঝড়ের কবলে পড়লে জাহাজ ডুবির আশঙ্কা ছিল। সেকারণে তারা সে সময়ে খুবই সস্তা লবণ জাহাজ ভরে নিয়ে আসত। যাত্রা শেষে সে সব নুন সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আবার জাহাজ খালি করত। ইংরেজদের ব্যবসাবুদ্ধি ছিল অতি প্রখর। তারা স্থানীয় কিছু অনুগত বাঙ্গালীকে ধরে এই লবণ বিক্রির ব্যবস্থা করে। তখন এদেশে লবণের কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু কোম্পানী বাজারে প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় লবণ বিক্রি থামিয়ে দিয়ে বিলেতি লবণ বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। সেই লবণের টাকায় অনেক বাঙ্গালী বিপুল অর্থসম্পত্তির মালিক হয়েছিল। তারা হয়েছিল দেওয়ান, উপদেওয়ান। কেউ কেউ হয়েছিলেন একদম নিঃস্ব থেকে উচ্চবিত্ত—মধ্যবিত্ত।
পদ্মলোচন নামে এক ভদ্রলোকবাবুর খবর জানতে পারা যায় হুতুম প্যাঁচার নকশায়। পদ্মলোচন খুব গরীব ঘরের সন্তান। গ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে গৃহভৃত্যের কাজ নেয়। কিন্তু কায়দা করে টাকাপয়সা আয় করে একজন বড় মানুষে পরিণত হয়েছিলে। হুতুম প্যাচার নকশায় লেখা হয়েছে —
''ক্রমে পদ্মলোচন নানা উপায়ে বিলক্ষণ দশ টাকা উপার্জন কত্তে লাগলেন, অবস্থা উপযোগী একটি নতুন বাড়ি কিনলেন, সহরের বড় মানুষ হলে যে সকল জিনিসপত্র উপাদানের আবশ্যক, সভাস্থ আত্মীয় ও মোসাহেবরা সেই সকল জিনিস সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ও উদর পূরণ করে ফেল্লেন, বাবু স্বয়ং পছন্দ করে (আপন চক্ষে সুবর্ণ বর্সে) একটি রাঁঢ়ও রাখলেন।''
আরেকজন বাবুর নাম জানা যায়—নাম বিশ্বনাথ মতিলাল। তিনি শেষ বয়সে এসে গান-বাজনা, হাফ-আখড়াই আর শখের যাত্রা নিয়ে খুব মেতেছিলেন। তার অগাধ সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন তার ছেলেপেলেদের মধ্যে। কোলকাতার তার এক ছেলের বউয়ের নামেই একটি বাজার বসিয়েছিলেন। সে বাজারটির নাম বউবাজার। এই বউবাজরটিতে সে সমযের বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য বারবণিতাদের সবচেয়ে পল্লী গড়ে উঠেছিল। এখানে এই বড় বড় বাবুরা ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার লুটপাটের টাকা পয়সা দিয়ে, জমিদারী প্রজাশোষণের টাকা দিয়ে তাদের রক্ষিতা রাঢ়দের জন্য বাড়ি করে দিতেন। ভাগ্যান্বষণে অনেক মুসলমান ও পশ্চিমা বাঈজিরাও এখানে আসর বসাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল নিকি বাঈ। তাকে তার বাবু প্রতিমাসে সে সময়ে এক হাজার টাকা দিয়ে পুষতেন। পাইকার, ব্যাপারী আর ইজারাদারদের রাত্রিবাসের জন্য অনেক টোটেল গড়ে উঠেছিল। সেখানে রাতকাটানোর জন্য বারবণিতাদের সহজে পাওয়া যেত। তাদের জন্য তখন সৌখিন পোষাক আষাক আর গহনার দোকানপাটেরও রমরমা ছিল।
পূর্ব বাংলা থেকে আসতেন বাঙ্গাল জমিদার, তালুকদার আর ইজারাদাররা। তারা আসতেন বজরায় করে। তাদের পাণ্ডারা ধরে বারবণিতাদের কাছে নিয়ে যেত। আর কিছুদিন ফূর্তিফার্তা করে সর্বস্ব খুইয়ে দেশে ফিরে যেত। আবার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে কোলকাতায় ফিরে আসত।
ঠিক সে সময়েই গ্রামের মানুষ না খেয়ে মরছে। সে সময়ে পথে ঘাটে, মন্দিরচত্বরে খ্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে অনেক মা তাদের শিশু সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতেন। পালিয়ে গিয়ে এদের উঠতে হত এইসব বউবাজারের মত বারবণিতা পল্লীতে।
১৮২০ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নববাবুবিলাস নামে একটি বই লেখেন। সেখানে বাবু বলতে তরুণ নব্যধনীদের কথা বুঝিয়েছেন। ইংরেজরা বাবু শব্দটিকে ইংরেজিজানা বাঙালি কেরানীকে বুঝত। তারা ১৭৮২ সালে এই বাবু শব্দটিকে দলিলপত্রাদিতে ব্যবহার করা শুরু করে। আর বাঙালিদের কাছে বাবু মানে মনিব।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যারা জমিদারি কিনে অথবা ব্যবসা বানিজ্য করে কৌলকাতায় নব্যধনী হয়েছিলেন–তারাই বাবু হিসেবে পরিচিত হতেন সে সময়ে। ১৮৫০ সালের দিকে বাবু বলতে সংবাদপত্রে জমিদার, ব্যবসায়অর সঙ্গে ধনী পরিবারের অলস তরুণদের বোঝানো হত। এরা ছিলেন আলালের ঘরের দুলাল। ১৮৬০ সালের দিকে বাবু শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তখন চাকরীজীবীদের মধ্যে বড়বাবু, ছোটো বাবু ইত্যাদি শব্দ এসে যায়। এমনকি পরিবারের বড়ো ভাইকে বড় বাবু, মেজো ভাইকে মেজো বাবু ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। বাবুদের গিন্নীদের বলা গত বিবি। ভাবানীচরণ এইসব বিবিদের নিয়ে নববিবিবিলাস নামে আরেকখানি বই লিখেছেন। মুসলমানদের মধ্যে বাবু শব্দটির বদলে সাহেব শব্দটিই বেছে নেওয়া হত।
এ ধরনের বাবু রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির একটি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ফেনি পার্কসের ভ্রমণকাহিনীতে। ভ্রমণকাহিনীর নাম Wanderings of a Pilgrim in search of Picturesque । তিনি ১৮২৩ সালে কলকাতায় রামোহনেরবাড়িতে নাচের আসরে যোগ দেন। তিনি লিখেছেন—
একদিন এক ধনিক সম্ভ্রান্ত বাঙালিবাবুর বাড়ি ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবুর নাম রামমোহন রায়। বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তার বাড়ি; ভোজের দিন নানা বর্ণের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চমৎকার আতসবাজির খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলোয় আলোকিত হয়েছিল তার বাড়ি।
বাড়িতে বড় বড় ঘর এবং একাধিক ঘরে বাইজি ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাইজিদের পরনে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙিন মসলিনের ফ্রিল দেওয়া, তার উপর সোনারূপার জরির কাজ করা। শাটিনের ঢিলে পায়জামা পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পোষাকে ও আলোয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলঙ্কার ছিল নানারকমের। …বাইজিদের একজনের নাম নিকি, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাইজিদের মধ্যে মহারানি সে, তার নাচগান শুনতে পাওয়া ভাগ্যের কথা।
ভদ্রলোক : ভদ্র হইলেও লোক বটে
উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বিশ শতকের প্রথমদিকে বাবুদের মধ্যে থেকে ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এরা কিছু দেশোদ্ধারের কাজকর্মে জড়িত থাকতেন। ইংরেজি শিক্ষার আলোকে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে আলোকিত হয়ে বাঙালি মানসে এ সময়কালে একটি জাগরণের ফলে বাবু থেকে ভদ্রলোকে রূপান্তর এসেছিল। তার কিছু পল ভাল হয়েছিল—কিছু খারাপ হয়েছিল। ১৮৭২ সালে ভদ্রলোক অর্থটি ভদ্র যে লোক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন হুতুম প্যাঁচার নকশা বইয়ে।
বঙ্কিমচন্দ্র ঠাট্টা করে এই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বাবুর একটি চিত্র এঁকেছেন—চসমা-অলঙ্কৃত, উদারচরিত্র, বহুভাষী। এরা নিজের ভাষাকে ঘৃণা করেন, পরের ভাষায় পারদর্শী। মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ। এঁরা বিনা উদ্দেশ্য সঞ্চয় করেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জন করেন, আপার্জনের জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে প্রশ্নপত্র চুরি করেন। এঁদের বল হস্তে এক গুণ, মুখে দশ গুণ এবং কার্যকালে এরা অদৃশ্য। এঁদের বুদ্ধি বাল্যে বইয়ের পাতায়, যৌবণে বোতলের মধ্যে, বার্ধক্যে গৃহিণীর আঁচলে। আরও মজা করে বঙ্কিম লিখেছেন—বাড়িয়ে এরা জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের কাছে গলাধাক্কা খান।
সোম প্রকাশ পত্রিকায় ১৮৬২ সালে একটি নিবন্ধে লেখা হয়—ভদ্রলোক, এ ব্যক্তি আপনার পরিবারকে খাইতে দয় না, বাটী যায় না, যেখানে পায় সেইখানে আহার ও শয়ন করে।
১৮৮৩ সালে সোমপ্রকাশ লেখে—কৃষিকার্য করা ভদ্রলোকের কর্ম নহে, তাহাতে লোকে চাষা বলিবে।
সপ্তম পর্ব——————————————–
বাংলায় বামুন
আর্যরা ভারতে আসার অনেক পরে বাংলায় তাদের সংস্কৃতির স্পর্শ পায় অনেক পরে। রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এই দেশকে আর্যরা খুব ভালো চোখে দেখেনি। বাংলা ছিল নিম্নবর্গের মানুষের জায়গা। দস্যুদের এলাকা। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দীর বেশিরভাগ সময়েও এদেশে ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠান অপেক্ষা বৌদ্ধ প্রভাবই অধিকতর পরিলক্ষিত হয়। সেই কারণেই তৎকালীন মহারজ আদিশুর কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে আনিয়েছিলেন। তারা বেদবিহিত পূজাঅর্চনা প্রচলন করেন। আধুনিক বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ। তারা জাতপাতের বিভেদের প্রাচীর তুলে সমাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। নিম্নবর্গের মানুষ শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নয়—ধর্মব্যবস্থায়ও নতুন নতুন নিপীড়নের শিকার হয়ে পড়ে।
বাংলায় ইসলাম
পাশাপাশি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে মুসলমানদের আক্রমণ ঘটে। তখন বাংলায় সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন ঘটে। কোথাও মুসলমান সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে কোথাওবা বা শাসক সম্প্রদায়ের ধর্মান্তকরণে প্রদত্ত সুযোগসুবিধার ফলে বা রাজানুগ্রহ পাওয়ার আকাঙ্খায় বা জাতে উঠার আকাঙ্খায়ও অনেক উচ্চবর্গের হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পাশাপাশি নিম্নবর্গের হিন্দুরা ইসলামের উদার নীতির কারণে আকৃষ্ট হয়। সে সময়ে দরবেশ-ফকিররাও ক্ষেতের আলে আলে নাচতে নাচতে—গাইতে গাইতে দিগন্তে পিঠ রেখে দেখা দিয়ে আসছেন। ঈশ্বরের কথা—আল্লার কথা তাঁদের গান হয়ে সন্ধ্যার শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে জনপদে মিশে গেছে। সাধারণ মানুষজন অনেকেই উদার ইসলাম গ্রহণ করেছে।
জাতের বামুন থেকে অজাতের পিরালী বামুন
ঘটনাটা পঞ্চদশ শতাব্দীর। তখন যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগণায় এক ঘর জমিদার ছিল। তার পদবী ছিল গুড়। তবে খাতা পত্রে এই গুড়দের রায়চৌধুরী বলা হত। সেখানকার জমিদার দক্ষিণানাথ গুড় বা রায়চৌধুরীর চার ছেলে—কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। সে সময়ে স্থানীয় এক মোগল শাসক ছিলেন মামুদ তাহির বা পীর আলি। এই পীর আলীর কৌশলে বা প্রলোভনে পড়ে বা আকৃষ্ট হয়ে কামদেব এবং জয়দেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে আরও একটি মত পাওয়া যায়– পীর আলী এই দুইভাইকে কৌশলে গোমাংস ভক্ষণ করান। এই ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেন পীর আলী। তখন তাদের মুসলমান হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাদের ছোটো দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব মুসলমান হয়নি। কিন্তু তাদের ভাই মুসলমান হয়েছে শুধু এই কারণে হিন্দুসমাজ তাদেরকে সমাজচ্যুত করে। তাদের সঙ্গে সর্বপ্রকার সামাজিক সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে কেউ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়াও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। এদের নাম হয় পিরালী বামুন বা পিরালী থাক। জাতে ছোটো। অছ্যুৎ।
অথচ মহাভারতে উল্লেখ আছে প্রাচীন সমাজে ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি সকলেরই প্রচুর মাংসাহার করতেন। ভদ্রসমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ বেদে পাওয়া যায়। রাজশেখর বসু মহাভারতের ভূমিকায় আরও জানাচ্ছেন, সেকালে অস্পৃশ্যতা কম ছিল—দাসদাসীরাও অন্ন পরিবেশ করত। কিন্তু কালক্রমে ব্রাহ্মণতন্ত্র কঠিনভাবে সমাজে কায়েম হয়ে পড়লে হিন্দু সমাজের এই উদারনীতি অনেকাংশেই পরিত্যাক্ত হয়।
এই সমাজচ্যূতির ফলে স্বশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিয়েশাদী বন্ধ হয়ে গেলে তারা ভিন্ন কৌশল করেন। তারা ছেলেমেয়েদের বিয়ের জন্য কৌশল ও প্রলোভনের জাল বিস্তার করেন। সাধারণত তারা টার্গেট করতেন গরীব ব্রাহ্মণদের। তাদেরকে টাকা পয়সা, জমিজিরেত ও ঘরজামাই করে মেয়ে গছাতেন। আর ছেলে বিয়ে দিলে মেয়ের বাপের বাড়ির লোড়ির লোকজনকে আর্থিকভাবে দাড় করানোর দায়িত্ব নিতেন।
ঘরজামাই থেকে জমিদারি
এ সময়কালেই বর্ধমান জেলার কুশগ্রামে একঘর ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। তারা কুশগ্রামের নামঅনুসারে কুশারী পদবী ব্যবহার করতেন। তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ শ্রোত্রিয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। সে গ্রামের জগন্নাথ কুশারী পিঠাভোগ নামের এক স্থানের জমিদার ছিলেন। তাঁর জীবৎকাল ছিল ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তখন মোগল শাসন ছিল।
বর্ধমানের পিঠাভোগের জগন্নাথ কুশারীকেও এইরকম কোনো একটি কৌশলে পিলারী বামুন শুকদেব গুড় কায়দা করে তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। ফলে জগন্নাথ কুশারীকে তার ভাইবেরাদার-আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে। সম্ভবত ছিন্নমূল হয়ে জগন্নাথ কুশারী যশোহরে শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। এবং ঘরজামাই হয়ে গেলেন। নরেন্দ্রপুরের উত্তরপশ্চিমকোণে উত্তরপাড়া গ্রামের সঙ্গে সংলগ্ন বারোপাড়া গ্রামে ঘর বাঁধেন। তিনিও পিরালী থাকের অন্তর্ভুক্ত অছ্যুৎ হয়ে গেলেন। শ্বশুর শুকদেব গুড় তাঁকে উত্তরপাড়া গ্রামটি দান করেন। এই গ্রামের আয় থেকেই তাঁর সংসার চলে। তাঁর চার ছেলে—প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, জগন্নাথ কুশারীই রবীন্দ্রনাথদের ঠাকুরবংশের আদিপুরুষ।
আজব শহর কোলকেত্তা আগমন
রবীন্দ্রনাথের উর্দ্ধতম নবম পুরুষ। তার জীবৎকাল ছিল সপ্তদশ শতাদ্বীর দ্বিতীয়ার্ধে। সে সময়ে জোব চার্নক কোলকাতা শহর পত্তন করছিল। তার ছেলে মহেশ বা মহেশ্বর যশোরের উত্তরপাড়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে কোলকাতা আসেন। আরেকটি মত আছে মহেশ নয় তার ছেলে পঞ্চানন কুশারী জ্ঞাতী কলহে ভিটা ত্যাগ করে কোলকাতায় চলে যান। সময়টা প্রায় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ।
জোব চার্নক জোব চার্নকের কোলকাতা