ইতিহাস বিকৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপাত্যের ক্ষমতায় টিকে থাকার অব্যর্থ রণকৌশল। বৌদ্ধময় ভারতের অবসানের পর বহুজন সমাজকে ছয় হজারের বেশী জাতে বিভক্ত করে অতি সংখ্যালঘু রা রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে। মিথ্যা ধর্মগ্রন্থে প্রত্যেকটি জাতির জন্মবিষয়ক অশ্লীল হাস্যকর কাহিনী পর্চলিত করে তাঁদের একের অপরের শত্রু করে দেওয়া হয়েছে। নমোশূদ্র, পৌন্ড্র, রাজবংশী, মালো, সদ্গোপ, মাহিষ্য সমেত হাজারো চাষি জাতি হয় অস্পৃশ্য, না হয় শুদ্র, যাদের এখন ওবিসি বলা হয়। পেশাগত পরিচিতি থেকে যদি সামাজিক অবস্থান ও জাত নির্ণয় হয়, তাহলে দেশের শতকরা সত্তর ভাগ চাষিরা হাজারো জাতিতে পরিচিত হবেন কেন? তাঁদের চাষি বললেই হয়! এমনটা হলেই বহুজন সমাজের পরিচিতি নির্মাণ হয়ে যায়, যার ভিত্তিতে গৌতম বুদ্ধ সারা পৃথীবীতে সবার আগে রক্তহীন বিপ্লব করেছিলেন।সেই পরিচিতিকে নষ্ট করতেই মনুস্মৃতি রচনা ও জাতি ব্যবস্থার সুচনা। যার দরুন বৌদ্ধময় ভারতে আবার ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রবল ভাবে ফিরে আসে।
ইতিহাস বিকৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপাত্যের ক্ষমতায় টিকে থাকার অব্যর্থ রণকৌশল। বৌদ্ধময় ভারতের অবসানের পর বহুজন সমাজকে ছয় হজারের বেশী জাতে বিভক্ত করে অতি সংখ্যালঘু রা রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে। মিথ্যা ধর্মগ্রন্থে প্রত্যেকটি জাতির জন্মবিষয়ক অশ্লীল হাস্যকর কাহিনী পর্চলিত করে তাঁদের একের অপরের শত্রু করে দেওয়া হয়েছে। নমোশূদ্র, পৌন্ড্র, রাজবংশী, মালো, সদ্গোপ, মাহিষ্য সমেত হাজারো চাষি জাতি হয় অস্পৃশ্য, না হয় শুদ্র, যাদের এখন ওবিসি বলা হয়। পেশাগত পরিচিতি থেকে যদি সামাজিক অবস্থান ও জাত নির্ণয় হয়, তাহলে দেশের শতকরা সত্তর ভাগ চাষিরা হাজারো জাতিতে পরিচিত হবেন কেন? তাঁদের চাষি বললেই হয়! এমনটা হলেই বহুজন সমাজের পরিচিতি নির্মাণ হয়ে যায়, যার ভিত্তিতে গৌতম বুদ্ধ সারা পৃথীবীতে সবার আগে রক্তহীন বিপ্লব করেছিলেন।সেই পরিচিতিকে নষ্ট করতেই মনুস্মৃতি রচনা ও জাতি ব্যবস্থার সুচনা। যার দরুন বৌদ্ধময় ভারতে আবার ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রবল ভাবে ফিরে আসে।বাংলা শুধু নয় সমস্ত ভারতীয় ভাষার জন্ম হয় চর্যাপদের গর্ভে, যা রচনা করেছেন আজকের অস্পৃশ্যরাই। ভায়া যদি পরিচিতি হয়. ভায়া যদি সংস্কৃতি হয়, হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, এবং ইতিহাস অনুযায়ী অন্ততঃ বাঙ্গালির পরিচিতি সদম্ভ মাতৃভাষার অহন্কারে, গৌরবে, তা পশ্চিমবঙ্গীয ব্রাঙ্মণ্যতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের কল্যাণে নয়, বাংলাদেশী অব্রাঙ্মণ অহিন্দু বঙ্গালির আত্মবলিদানী সমাজবাস্তবের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য।
পলাশ বিশ্বাস
মতুয়া নামের উদ্ভব সম্পর্কে শ্রীশ্রীহরীলীলামৃত গ্রন্হে বলা হয়েছে-- মেতেযায় হরি বলে,ভঙ্গী করে কত, হরি বলে মেতে থাকে ওব্যাট্যারা মতো ।। হরি ধ্যান হরি ... এটাই মতুয়া মতবাদ । মতুয়া-মতবাদের প্রধান দিক হলো- হাতে কাম,মুখে নাম,মূলমন্ত্র হরিনাম । হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া- মতবাদ পূর্নাঙ্গ জীবন- ব্যাবস্থা গ্রহনে মানুষকে সহায়তা করে।
আত্মঘাতী বাঙ্গালি সবার আগে নিজের ইতিহাস ভূগোলকেই আক্রমণ করে।ব্রাহ্হণ্যতন্ত্রের রক্তিম আধিপাত্য স্থাপনে ভারত ও বাংলা ভাগের ষড়যন্ত্ররুপায়ণে বাঙ্গালি কুলীণ হাত কাঁপে নি। বাংলার তফসিলী জনগোষ্ঠীসমুহকে তাঁদের জন্মভূমি থেকে বহিস্কৃত করে , উদ্বাস্তু রুপে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে শাষক শ্রেণীর হাত এতটুকু কাঁপেনি। দন্ডকারণ্যে অথবা সমুদ্রঘেরা আন্দামান নিকোবার দ্বীপ মন্ডলে, আসাম ত্রিপুরা অথবা উত্তরাখন্ড থেকে রাজস্থানের মরুভূমি, তামিলনাডুর নীলগিরির জঙ্গলে অরণ্যে যাদের নির্বাসিত করা হল, বাংলা তাঁদের খোংজ রাখেনি।তাঁরা যখন মরিচঝাংপিতে ফিরে এসে নিজের নূতন ইতিহাস গড়তে চেষ্টা করেছে, শাসকশ্রেণীর গণসংহার সংস্কৃতির আগ্রাসী নির্মম আক্রমণে নিশ্চহ্ন হতে হল তাঁদের।ভারত ভাগের ফলে সারা ভারতে তফসিলী, দলিত সংখ্যালঘু মানুষের ক্ষমতায়নে অগ্রণী যে ভূমিকা ছিল বাংলার, তা শেষ করে দেওয়া হলই। ইতিমধ্যে 2003 ও 2005 সালে বাংলার গৌরব ব্রাহ্মণসন্তান প্রণব মুখার্জীর প্রচেষ্টায় সর্বদলীয় সম্মতিতে উদ্বাস্তু বহুজনসমাজকে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন মাধ্যমে নাগরিকত্ব, জীবন , জীবিকা ও মানব অধিকার থেকেও বন্চিত করা হল।পশ্টিম বঙ্গ বাংলার অতীতকে মুছে ফেলে দিয়ে অব্রাহ্মণ্য ইতিহাসকে ব্রাঙ্মণ্যতন্ত্রের ইতিহাসে পরিণত করে ফেলেছে। একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই ভারত বর্ষে যে ব্রাত্য অনার্য্য অসুর ভূমি বৌদ্ধময় ছিল , তাংর যাবতীয় চিন্হ প্রতিষ্ঠানিক ভাবে মুছে দেওয়া হল, ঠিক মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রিত্বে অভিষেকের পরপরই বাংলার মাটি থেকে যে ভাবে লাল রং মুছে ফেলার অভিযান চলছে, যে ভাবে সিপিএম বলতেই হারমাদ বাহিনী, গেস্টাপো, গণশত্রু বোঝানো হচ্ছে, ঠিক তেমনিই অতীতের গণতান্ত্রিক বৌদ্ধ শাসকশ্রেণীকে পুজো, সংস্কারে পদে পদে, সাহিত্যে সংস্কৃতিতে সুপরিকল্পিত ভাবে অসুর বলা হয়।বহুসংখ্য বহুজনসমাজের বিরুদ্ধে ঘৃণার উত্সবই এখন এ রাজ্যের সংস্কৃতি।অথচ চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের আগে বাঙ্গালি যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা বিষ্ণুকেই ঠিক ভাবে চিনত কিনা তাংর প্রণাণ নেই। তাঁর আগে জয়দেবের গীত গোবিন্দ সংস্কৃত মহাকাব্যে কৃষ্ণ চরিত্র অবতরিত হয়।বল্লাল সেনের সশাসনকালের পূর্বে বাংলায় অস্পৃশ্যতার ইতিহাস নেই। ব্রাঙ্মণ্য সংস্কৃতি, কর্মকান্ডের কোনও নজির নেইন কন্নৌজ থেকে আমদানি করা হয় ব্রাহ্মণদের। বর্ণ ব্যবস্থা অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপে থাকা ক্ষত্রিয়দের অস্তিত্ব কোনও কালে বাংলায় ছিল না। এই সেদিন পর্যন্ত ইংরাজ শাসনকালেও শুধু বাংলা নয়, মধ্যভারত, মহারাষ্ট্র ও পূর্ব ভারতে অনার্য শুদ্র রাজা রাণিদের রাজত্ব ছিল, যাদের আমরা চুয়াড় সম্বোধন করে থাকি। বাংলার শেষ শাসক কাগজে কলমে বলা হয় সিরাজদৌল্লাকে, কিন্তু তিনি ছিলেন জেলের মেয়ে রাণি রাসমণি।ইতিহাস বিকৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপাত্যের ক্ষমতায় টিকে থাকার অব্যর্থ রণকৌশল। বৌদ্ধময় ভারতের অবসানের পর বহুজন সমাজকে ছয় হজারের বেশী জাতে বিভক্ত করে অতি সংখ্যালঘু রা রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে। মিথ্যা ধর্মগ্রন্থে প্রত্যেকটি জাতির জন্মবিষয়ক অশ্লীল হাস্যকর কাহিনী পর্চলিত করে তাঁদের একের অপরের শত্রু করে দেওয়া হয়েছে। নমোশূদ্র, পৌন্ড্র, রাজবংশী, মালো, সদ্গোপ, মাহিষ্য সমেত হাজারো চাষি জাতি হয় অস্পৃশ্য, না হয় শুদ্র, যাদের এখন ওবিসি বলা হয়। পেশাগত পরিচিতি থেকে যদি সামাজিক অবস্থান ও জাত নির্ণয় হয়, তাহলে দেশের শতকরা সত্তর ভাগ চাষিরা হাজারো জাতিতে পরিচিত হবেন কেন? তাঁদের চাষি বললেই হয়! এমনটা হলেই বহুজন সমাজের পরিচিতি নির্মাণ হয়ে যায়, যার ভিত্তিতে গৌতম বুদ্ধ সারা পৃথীবীতে সবার আগে রক্তহীন বিপ্লব করেছিলেন।সেই পরিচিতিকে নষ্ট করতেই মনুস্মৃতি রচনা ও জাতি ব্যবস্থার সুচনা। যার দরুন বৌদ্ধময় ভারতে আবার ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রবল ভাবে ফিরে আসে।বাংলা শুধু নয় সমস্ত ভারতীয় ভাষার জন্ম হয় চর্যাপদের গর্ভে, যা রচনা করেছেন আজকের অস্পৃশ্যরাই। ভায়া যদি পরিচিতি হয়. ভায়া যদি সংস্কৃতি হয়, হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, এবং ইতিহাস অনুযায়ী অন্ততঃ বাঙ্গালির পরিচিতি সদম্ভ মাতৃভাষার অহন্কারে, গৌরবে, তা পশ্চিমবঙ্গীয ব্রাঙ্মণ্যতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের কল্যাণে নয়, বাংলাদেশী অব্রাঙ্মণ অহিন্দু বঙ্গালির আত্মবলিদানী সমাজবাস্তবের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য।
ভারতবর্ষে ্স্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন কিন্তু জ্যোতিবা ফুলে, পেরিয়ার বা নারায়নস্বামির বহু পুর্বে হরিচাঁদ ঠাকুরই শুরু করেছিলেন।শেখর বন্দোপাধ্যায় অন্ততঃ চন্ডাল আন্দোলনের ইতিহাস লিখে বাঙ্গালির এই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।চন্ডাল আন্দোলনের জন্যই সারা ভারতে, সারা পৃথীবীতে সবার আগে অস্পৃশ্যতা নিবারম আইন বলবত হয়, এমনকি বাবাসাহেব ভীমরাো আম্বেডকরের আন্দোলন শুরু করার আগেই।বিভাজনপূর্ব বাঙ্গালি তফসিলিদের একতার ফলেই বাবাসাহেব মহারাষ্ট্র থেকে পরাজিত হয়েও বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান সভায় ঠুকতে পারেন।সারা দেশ এই ইতিহাসকে মনে রেখেছে।ভারতের বহুজনসমাজে হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বিরোধী মতুয়া ান্দোলনেক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বাংলায় সেই ইতিহাস মুছে দেওয়া হল। মহারাষ্ট্র সরকার সে রাজ্যে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে ছুটি প্রচলিত করেছিল, যা পশ্চিম বঙ্গে মতুয়া মমতা ব্যানার্জির রাজত্বে অকল্পনীয়। কিন্ত ইতিহাস, ভূগোল,মাতৃভাষা ও আত্মপরিচিতি থেকে বেদখল ভারতভাগের বলি মহারাষ্ট্রে পুনর্বাসিত এক শ্রেণীর ব্ররাঙ্মণ্যতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে দীক্ষিত উদ্বাস্তুদের বিরোধিতায় সেই ছুটি বাতিল হয়ে যায়।পশ্চিম বঙ্গে ভোট ব্যতীত মতুয়াদের স্বীকৃতি ঠাকুরের বংশধরদের পাইয়ে দেবার রণকৌশল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এই বিষম প্রতিকুল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে হরিচাঁদ ঠাকুরকে শামিল করা সত্যিই স্বাগত।তা নিয়ে বিবাদের অবকাশ নেই। কিন্তু ব্রাঙ্মণ্যতন্ত্রের অধীন যে ইতিহাস রচনা হয় মেনস্ট্রীম বহুজনসংস্কৃতিকে সেখানে লোকায়ত বা সাবআল্টার্ম বলা হয়।কেউ প্রশ্ন করে না যে বাংলার ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্যবাদ যখন এই সেদিনও ছিল না তাহলে সে আবার কবে মেন স্ট্রীম হল। যে হরিটাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, তাঁকে খারিজ করে সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বৌদ্ধময় ভারতের ঐতিহ্য অনুযায়ী মতুয়া ধর্ম প্রচলিত করে ছিলেন, যাঁরা ছিলেন হিন্দু মুস্লিম নির্বিশেষ ব্রাত্য, অপাংতেয়, চাষি, সব পিছিয়ে পড়া মানুষের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবের উজ্জবলতম নক্ষত্র, তাঁদের বংশধররাই মহাগৌরবে হরিচাঁদ ঠাকুরকে মৌথিলী ব্রাহ্মণের সন্তান ঘোষিত করে নিজেদের শাসকশ্রেণীতে উন্নীত করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে হরিচাঁদ ঠাকুরের পরিচিতি বিকৃতির উত্স সেখানেই।
এই প্রসঙ্গে মুমবাই প্রবাসী বন্ধুবর জগদীশ রায় ফেসবুক ওয়ালে মুল্যবান মন্তব্য করছেন, যা তুলে ধরলাম।
হরিচাঁদ ঠাকুরকে কারা পূর্ণ ব্রঙ্ম, অবতার, বৈষ্ণবমত প্রচারক চৈতন্যঅনুযায়ী, মৈথিলী ব্রাঙ্মণ প্রমামিত করছেন,মতুয়া সাহিত্যে তার নিদ্রশন রয়েছে।মতুয়ারাই নিজের অজান্তে েই মত প্রচলিত করছে ইতিহাস বিকৃতির চক্রান্তে।
ধর্মাতলার তৃণমূলের সমাবেশে হাজির সরকারি কর্মচারী
Update: January 19, 2013 21:15 IST
ফাঁকিবাজ সরকারি কর্মীরা সবাই সিপিআইএমের লোক। শুক্রবারই নদিয়ায় বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর শনিবারই অফিসের কাজ ফেলে ধর্মতলার সমাবেশে এলেন বহু তৃণমূল কর্মী। সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা সেই মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, যে সব সরকারি কর্মচারী কাজে ফাঁকি দেন, তাঁরা সিপিআইএমের লোক।
এঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, নদিয়ার জনসভায় তাও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু দিন ঘুরতেই যে একেবারে উল্টো ছবিটা সামনে চলে এল। ধর্মতলায় মুখ্যমন্ত্রীর সভায় তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের অনেকেই এলেন দল বেঁধে, অফিসের কাজ ফেলে।
যেমন নোনাপুকুর ট্রামডিপোর কর্মীরা। তাঁরা এলেন একেবারে লিখিত অনুমতি নিয়ে। লিখিত অনুমতি নিয়ে কাজ ফেলে সভায় গেলেন তাঁরা।
ষাট জন কর্মী একসঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ায় সরকারি বাস চালাতে কর্তৃপক্ষকে যে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপরেও কি ফাঁকিবাজরা সবাই সিপিআইএম, মুখ্যমন্ত্রীর এই তত্ত্বটা খাটে? হয়তো উত্তরটা জানেন শুধু মুখ্যমন্ত্রীই।
"EMAIL ID-roy.1472@gmail.com SKYPE ID-jagadish.roy2 M.No.9969368536 প্রথমেই জানিয়ে দিতে চাই যে, এই লেখা কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করার উদ্দেশ্যে নয়মতবুও যদি কারো বিশ্বাসে আঘাত পৌঁছায় তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । কোন মহা মানব/মানবী'র আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি কোন সমাজের উদ্ধারের কাজ কররে সেটা যেমন সামগ্রীক কল্যানের জন্য হয়, তেমনি তিনিও তখন আর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে রববেচিত হন না। তিনি দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সকলের হয়ে যান । বিশেস করে তাঁর কর্ম ও অদর্শকে যারা অনুসরণ করেন ,তাদের কাচে তিনি মহানরূপে বিবেচিত হন । গত কয়েক দিন ধরে Facebook এ দেখছি ,বাংলাদেশের পা্ঠ্য পুস্তকে "শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর " Subject এ যে বর্ননা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক । যেমন-(হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতা) যশোমন্ত ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ ।(হরিচাঁদ ঠাকুর) তিনি নতুন কোন ধর্ম প্রচার করেননি । তিনি মহাপ্রভু শ্রীচেতন্যের হরিনাম প্রচার করেছেন । ইত্যাদি । এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত,যুক্তি ও প্রমান দেওয়ার চেষ্টা করচি । মহাকবি তারক সরকার রচিত 'শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত'-এর বংশ তালিকায় দেখান হয়েছে যে, হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ মৈথিলী ব্রাহ্মণ ছিলেন । এটাকে প্রমান হিসাবে ধরলে আমরা বলতে পারি যে, হরিচাঁদ ঠাকুর নিজে এবং পরবর্তী বংশধররা ও স্বাভাবিক ভাবে ব্রাহ্মণ হবেন । তাহলে কোন বিবাদই থাকেনা, তাই নয় কি? এবার আমার প্রশ্ন হচ্ছে-হরিচাদ ঠকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-(যেটা আমরা মহানন্দ হালদার রচিত 'শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত'-এ পাই) নমঃশূদ্র কুলে জন্ম হয়েছে আমার । তাই বলে আমি নহি নমোর একার ।। এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুর সুম্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে, তিনি নমঃশূদ্রের ঘরে জন্ম গ্রহন করেছেন । এর পরে আমরা আরো দেখতে পাই যে, পি.আর. ঠাকুর ও মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর (যাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধর) ভারতে তফশীলিদের জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন এবং আইন সভার সদস্য হয়েছেন। তাহলে ওটা প্রমান হিসাবে ধরে নেওয়া যায় যে, তাঁদের তফশীলি প্রমানপত্র আছে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পূর্ব পুরুষ ব্রাহ্মণ হন কিভাবে ? আর এ প্রশ্ন মতুয়া সংঙ্গের কাছে ও রইল । (আমার কাছে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে শ্রীহরিবর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত যে শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত আছে তাতে কিন্তু কোন বংশ তালিকা নেই। এবার আসি হরিচাঁদ ঠাকুর বৈষ্ণব ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম বা ব্রাহ্মণ ধর্মের প্রচার করেচেন নাকি সত্যি সত্যি তাঁর মতবদীদের অন্য ধর্মের বাণী শুনিয়েছেন ? ,বাংলাদেশের পা্ঠ্য পুস্তকে লেখা হয়েছে- '(হরিচাঁদ ঠাকুর) তিনি নতুন কোন ধর্ম প্রচার করেননি । তিনি মহাপ্রভু শ্রীচেতন্যের হরিনাম প্রচার করেছেন।' আমরা 'শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত'-এ প্রথমেই দেখতে পাই যে, বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য । যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।। বুদ্ধের কি কামনা ছিল ?বুদ্ধ চাইতেন সমাজ ,দেশ ও দশের কল্যান হোক, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ মিটে যাক। সব মানুষ সমান অধিকার অর্জন করুক এক কথায় –সমতা,স্বতন্ত্রতা,বন্ধুতা ও ন্যায় ।এইকামনা কে পূর্ণ করার জন্যই হরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব ।আর তিনি এটাই করার চেষ্টা করেছেন । হরিচাঁদ ঠাকুরের বাবা যশোমন্ত বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন এটা নিঃসন্দেহ । কিস্তু বালক হরিচাঁদ বৈষ্ণবদের আচার আচরনকে একটুও পছন্দ করতেন না । তাই বৈষ্ণবরা স্নান করতে গেলে বালক হরিচাঁদ তাদের ঝোলা গুলো উল্টিয়ে দিত । এতে তার বাবা রেগে গিয়ে তাকে শাস্তি দিলে সে কিন্তু বলত বৈষ্ণবরা ভন্ড ওদের চলে যেতে বল । ঝোলা রাখি বৈষ্ণবরা স্নানে পানে যায়। উজাড় করিয়া ঝোলা ঠাকুর ফেলায় ।। দুরন্ত অশান্ত পুত্রে পিতা দেয় দন্ড । কেঁদে বলে হরিচাঁদ বৈরাগীরা ভন্ড ।। পিতৃ-কোলে থাকি হরি ক্রোধ করি বলে । ভন্ডবেটা বৈরাগীরা দূরে যারে চলে ।। হরিচাঁদ ঠাকুর তথা কথিত স্কুল শিক্ষা গ্রহন করতে না পারলেও সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কার তাঁকে ব্যথিত করে তোলে ।তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কুটিলতাকে ভালভাবে বুঝতে পারেন ।তাই তিনি ঘোষণা করেন- ব্রাহ্মণ্ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ। ব্রাহ্মণ্ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র ।। এখনে তিনি ব্রাহ্মণ্ দের রচিত গ্রন্থকে বিজ্ঞাপন যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন । তিনি আবার বলেছেন- কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই । বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই ।। সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হইবেক যেই । না থাকুক ক্রিয়াকর্ম হরি তুল্য সেই ।। এখানে তিনি বেদ অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের আকর গ্রন্থ 'বেদ'কে মানতে চাননি । বেদে যে নিয়ম কানুন আছে তাকেও তিনি অস্বীকার করেছেন । তিনি মানুষকে সত্যবাদী হ'তে বলেছেন । পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে বলেছেন ।আর যিনি সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয় হবেন তিনি ও হরি তুল্য হবেন। তিনি কোন ক্রিয়া কর্ম না করলেও তাতে কোন অসুবিধা নেই বলেছেন । হরিচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণদের ও বৈষ্ণবদের দূরভী সন্ধিকে খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তাই তিনি আবার স্পষ্ট ঘোষণা করলেন- নামে প্রেমে মাতোয়ারা মতুয়ারা সব । কোথায় ব্রাহ্মণ লাগে কোথায় বৈষ্ণব ।। কোথায় ব্রাহ্মণ কোথায় বৈষ্ণব । স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভন্ড সব ।। এবার বলুন যিনি বৈষ্ণবদের তীব্র বিরোধীতা করেছেন ,তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক কি করে হন? যিনি বেদেকে অস্বীকার করেছেন ,তিনি তিনি হিন্দু ধর্মের প্রচারক কি করে হন? যেখানে তিনি ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের ভন্ড বলেছেন , অর্থলোভী বলেছেন , সেখানে তাঁর উপর আমরা বৈষ্ণব ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের প্রচারকের তকমা কিভাবে লাগাতে পারি ? এটা তাঁর প্রতি ও তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি অবমাননা নয় কি? সর্বপরি এটা মতুয়া ধর্ম ও মতুয়া অনুনায়ীদের প্রতি অবমাননা নয় কি? ঐ পাঠ্যপুস্ককে আর একটি খথা বলা হয়েছে- "মতুয়া সম্প্রদায় তাঁকে(হরিচাঁদ ঠাকুরকে) বিষ্ণুর অবতার হিসাবে জ্ঞান করেন । তাই তারা বলেন-রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ। সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ ।।" এ বিষয়ে আমি সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের লেখা 'মতুয়া ধর্ম এক ধর্ম বিপ্লব' বই-এর ৩৩ ও ৩৪ পৃ:থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি –'লীলামৃত গ্রন্থে রাম,কৃষ্ণ ,শ্রীচৈতন্য সবার উল্লেখ আছে । তাদের অবতার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে । কিন্তু নানা কথার আড়ালে তারকচন্দ্র যখন লেখেন- নিত্যানন্দ হরি কৃষ্ণ হরি গৌরহরি । হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি ।। ....................................... এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে । ব্রহ্মা,বিষ্ণু,শিব অতিক্ষুদ্র তার কাছে ।। -এ কথায় আমরা কি বুঝি ?নকলকে নকল না বলেও হরিচাঁদের আগে 'আসল' শব্দটা জুড়ে দিয়ে তারকচন্দ্র আমাদের নকল চিনিয়ে দেন ।পরম্পরা আর থাকে না । কারণ আসল ও নকলে পরম্পরা হয় না,থাকে বৈপরিত্য । ভদ্রভাষায়, সৌজন্যতার সীমা অতিক্রম না করে, অতীব সূক্ষভাবে রসরাজ তারক সরকার আমারদের যে গভীর শিক্ষা দিয়েছেন, তা খুঁজে নিতে হবে । দুষ্কৃতি বিনাশ আর ধর্ম সংস্থাপণ । গৌরাঙ্গের প্রেমবাণে ধরা ডুবে যায় । সেই প্রেম শুষ্ক হলো কলির মায়ায় ।। ............................................ দূরন্ত কলির মায়া প্রকৃতি সহায়ে । ভাঙ্গিল প্রেমের হাট 'কুস্রোত' বহায়ে ।। অর্থাৎ তারক সরকারের সুস্পষ্ট অভিমত হল-শ্রীচৈতন্যের আন্দোলনের চুড়ান্ত পরিনতি হল-তা সমাজের ক্ষেত্রে ,সমাজ প্রগতির ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব ফেলেছে ।-যে মতবাদের পরিনতি 'কুস্রোত' বা মন্দের দিকে প্রবাহিত, তাকে কখনও হরিচাঁদের মতবাদ বা মতুয়াধর্মের পাশাপাশি রাখা যায় না।""
অন্ত্যজ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত
আনন্দবাজার – শনি, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
এ দেশের ইতিহাস-আখ্যানে জাতি ও জাতীয়তাবাদের উদ্ভব নিয়ে বহু বাদানুবাদ হলেও জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক উপাখ্যানের বড়ই অভাব ছিল। জাতের বজ্জাতি নিয়ে সাহিত্য আছে, কিন্তু জাতের সামাজিক ইতিহাস ছিল বাড়ন্ত। সেই অভাব পূরণে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় যে একনিষ্ঠ উদ্যম দেখিয়েছেন, তারই ফল এই ক্লাসিকধর্মী গবেষণাগ্রন্থটি। নমঃশূদ্র জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থটি বিলেত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বছর পনেরো আগে। গ্রন্থটি মহার্ঘ্য, ফলত দুর্লভ ছিল এ দেশে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের এই সংশোধিত-সংযোজিত সংস্করণটি সহজলভ্য হওয়ায় উৎসাহী পাঠক গ্রন্থটি সংগ্রহ করতে পারবেন।
আমাদের জাতীয় আন্দোলন ছিল প্রধানত উঁচু জাতের কাজিয়া। গাঁধীর যোগদান এই আন্দোলনে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল, কিন্তু সেই পরিবর্তন ছিল নিতান্তই প্রসাধনিক। সাবেক ইতিহাসরচনা এই প্রান্তকায়িত অন্ত্যজ গোষ্ঠীর ব্যাপারে নীরব থাকলেও সাম্প্রতিক কালে উনিশ শতকের নিম্নবর্গীয় ও অস্পৃশ্য মানুষদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়েছে। পরস্পর-বিরোধী প্রধানত দু'ধরনের ব্যাখ্যা মিলেছে। এক: অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন সর্বজনীন ছিল না। আসলে অন্ত্যজদের মধ্যে যারা আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন, তারাই সামাজিক ঊর্ধ্বায়ণের অভিলাষে আন্দোলনমুখী হয়েছিল। এরা শুরুতে উচ্চবর্ণের সামাজিক মর্যাদার প্রতীকচিহ্নগুলি আত্মস্থ করতে চেয়েছিল; শেষে তাদের দৃষ্টি শুধু প্রতীকেই নিবদ্ধ থাকেনি, ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষা ও চাকুরির মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখলের দিকেও ধাবিত হয়েছিল। দুই: অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন আসলে আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। নিম্নবর্ণের অন্তর্গত সামাজিক নিকৃষ্টতা ভাবনাই জাতি-আন্দোলনে প্ররোচনা দিয়েছে। সুতরাং, শেষ বিচারে, এই আন্দোলন প্রচলিত হিন্দু জাতি-কাঠামোর বিরুদ্ধেই ঘোষিত হয়েছিল।
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই অভিমতের কোনওটিকেই পুরোপুরি সত্য বলে মানেননি। তাঁর মতে, প্রথম ব্যাখ্যায় অন্ত্যজ গোষ্ঠীর আন্দোলনে প্রতিবাদের আখ্যানটি পুরোপুরি আড়াল হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় ভ্রান্ত ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, একটি অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠী অবিমিশ্র মানুষের সুষম সমাহার, একই সামাজিক পরিস্থিতিতে, একই বৌদ্ধিক চৈতন্যে, একই সামাজিক সম্পদের ভোগের ভাগীদার কিংবা দুর্ভোগের শিকার। জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে এই একশৈলিক আকার-প্রকার ভাবনা অনৈতিহাসিক, কেননা ঔপনিবেশিক শাসনকালে প্রতিটি অন্ত্যজ গোষ্ঠী তাদের সামাজিক আচার-আচরণের অভিন্নতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় আলাদা ছিল।
নমঃশূদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবাদী আন্দোলন ও আত্মপরিচয় আলোচনাকালে লেখক দেখিয়েছেন অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর আন্দোলন অর্থের রিক্ততা কিংবা বিত্তের অতিরিক্ততা কোনও অবস্থান থেকেই নিরঙ্কুশ ভাবে উৎসারিত হয়নি। এমনকী কোনও জাতিগোষ্ঠী নিছক রাজনৈতিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠাকল্পেই জাত-চিহ্নকে 'প্রতীকী মূলধন' হিসেবে ব্যবহার করেনি। পরিস্থিতিটি ছিল যথেষ্ট জটিল এবং বহুমাত্রিক। জাতিগোষ্ঠীর জীবনচর্যায় বিধৃত সামাজিক প্রান্তিকতার যাবতীয় চিহ্ন আরও তীক্ষ্নতর হয়ে গোষ্ঠীর সামূহিক পরিচয়কেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারপর সেই গোষ্ঠী যখন তাদের নিজস্ব জনজীবনের লৌকিক কল্পকথা ও বীরগাথা উদ্ভাবন করে গোষ্ঠী-পরিচয়কে সুনির্দিষ্ট আকার দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তখন উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধেছে।
এই ঐতিহাসিক সত্যকেও লেখক নিরঙ্কুশ মনে করেননি। কেননা, তিনি লক্ষ করেছেন একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবাদী উচ্চারণ এক ও অভিন্ন থাকেনি। সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বিষম স্ববিরোধ মাঝে মাঝেই বৈরিতার সৃষ্টি করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের শেষের দিকে একটি অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠী কী ভাবে প্রতিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের 'নমঃশূদ্র' নামে স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণ করেছিল। আবার, কী ভাবে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেই জনগোষ্ঠী তাদের স্বাতন্ত্র্য এবং অস্মিতা হারিয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্রোতে অন্তর্হিত হল।
ঔপনিবেশিক বাংলায় নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু জাতিগোষ্ঠী এবং পূর্ব বাংলার বৃহত্তম হিন্দু কৃষক সম্প্রদায়। আবার, নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন ঔপনিবেশিক বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী তফসিলি জাতি-আন্দোলন। নমঃশূদ্ররা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে গত শতকের তিরিশের দশক পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ঐতিহাসিকরা মানেন, এই বিচ্ছিন্নতা মুসলিম বিচ্ছিন্নতার মতোই এ দেশের জাতীয় আন্দোলনকে নানা ভাবে আহত ও দুর্বল করেছিল। লেখক সঙ্গত কারণেই তাই অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন কেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদকে বর্জন করেছিল আর কেনই বা তারা শেষ পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল।
লেখকের মতে, নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদের আখ্যানে পর্যবসিত হয়নি। পর্যায়ক্রমে কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয়তাবাদী, হিন্দু মহাসভা প্ররোচিত সাম্প্রদায়িকতাবাদী, কমিউনিস্ট অনুপ্রাণিত কৃষক জনবাদী আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের শামিল হওয়া ইতিহাসসিদ্ধ গতিশীলতারই ইঙ্গিতবাহী। নমঃশূদ্র আন্দোলনের এই ঘটমান বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, গোষ্ঠীচেতনা অবস্থানগত প্রেক্ষিতে কল্পিত এবং পরিকল্পিত হতে পারে। আবার, গোষ্ঠীর কাঠামোগত বিন্যাসে বিভিন্নতা থাকলে আন্দোলনের নির্মাণ ও বিনির্মাণেও বৈচিত্র আসতে পারে। লেখক দেখিয়েছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অগ্রণী নমঃশূদ্ররা নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অংশীদার হতে চাইলেও, প্রান্তিক নমঃশূদ্ররা সনাতন গোষ্ঠীর সম্মানরক্ষা, সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির আন্দোলনেই বেশি উৎসাহী ছিল। যে অগ্রণী নমঃশূদ্ররা বৃহত্তর জাতীয় পরিস্থিতিতে নিজেদের ক্ষমতায়ন অন্বেষণ করেছিল, তারা ১৯৩৫-এর সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্যে নিজেদের অবস্থার অনেকটা সুরাহা লক্ষ করে। ফলত অধস্তন নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। প্রান্তিক নমঃশূদ্ররাও আর 'এলিট' নমঃশূদ্রদের মুখাপেক্ষী ছিল না। তারাও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের লক্ষ্যে নতুন নেতৃত্বের সন্ধান করে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৪০-এর দশকে আন্দোলনের প্রতিবাদী কণ্ঠটি নিরুদ্ধ হয়ে গেল নতুন গোষ্ঠী-পরিচয়ের বিকাশের মাধ্যমে আসন্ন দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে। সাবেক আন্দোলনের কিছু নেতা অম্বেডকরের তফসিলি জাতিসংঘে রয়ে গেলেন, কিছু নেতা এলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। কৃষকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভার পতাকাতলে সমবেত হল, কখনও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভার নেতৃত্বে জঙ্গি-আন্দোলনে শামিল হল। দেশভাগের ভৌগোলিক খণ্ডতা নমঃশূদ্র জাতির আন্দোলনের ইতিহাসকে খণ্ডিত করল।
গ্রন্থটিতে একটি মূল্যবান পরিশিষ্ট সংযোজিত হয়েছে দেশভাগ-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে নমঃশূদ্র আন্দোলনের হাল-হকিকত নিয়ে। লেখক এখানে দু'টি প্রধান প্রশ্ন তুলেছেন। দেশভাগের পর যে-নমঃশূদ্ররা পশ্চিমবঙ্গে চলে এলেন, তাঁদের কী হল, তাঁদের প্রতিবাদী আন্দোলন পরিত্যক্ত হল কেন? আর, ঔপনিবেশিক বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের পুরোধা সংগঠন মতুয়া সংঘ ২০১০-১১-এর বঙ্গীয় রাজনীতির আবর্তে কেনই বা আবার ভেসে উঠল।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের যে ইতিহাস তিনি আমাদের শুনিয়েছেন, তা হল, অন্ত্যজ নমঃশূদ্ররা সামাজিক অবিচারের ভার বহনের ক্লান্তিকর ন্যুব্জ অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে কী ভাবে সংহতি থেকে সংঘাত, প্রতিবাদ থেকে সহাবস্থান, আর বিচ্ছিন্নতার বিমুক্তি থেকে জাতীয় সংযুক্তির ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কাহিনি।
আনন্দবাজার পত্রিকা
মমতার সাফল্যে একজন 'বড়মার' অবদান
মিজানুর রহমান খান, ঠাকুরনগর (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে | তারিখ: ১৯-০৫-২০১১
দুই বাংলার শূদ্ররা আজ আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। অন্তত ১৩ জন শূদ্র (অধুনা 'মতুয়া' ধর্মে দীক্ষিত) বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবার, যা একটি রেকর্ড। একসময় অবহেলিত ও লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শূদ্রদের সমাজে মর্যাদার আসনে বসাতে মমতা অনেক কিছু করেছেন। ৪০০ বছর আগে ফরিদপুরের ওড়াকান্দি থেকে যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল, মমতার কারণে তা একটি বড় মাইলফলক পেরোল। পশ্চিমবঙ্গে সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০টির ফলে কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে শূদ্ররা। উল্লেখ্য, হিন্দুসমাজের বর্ণপ্রথার সর্বশেষ ধাপে শূদ্রদের অবস্থান। দুই বাংলার শূদ্রদের বিষয়ে বিশিষ্ট ভারতীয় গবেষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, 'দুই বাংলার ইতিহাসে এই ঘটনা অসাধারণ ও ঐতিহাসিক।' একদা ফরিদপুরের অন্তর্গত ওড়াকান্দিতে (বর্তমানে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানাধীন) আজ থেকে চার শতাব্দী আগে জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক আন্দোলনের সূচনা হয়। সেখানেই পরবর্তী সময়ে 'মতুয়া' ধর্ম প্রবর্তন এবং শূদ্রদের মধ্যে তা গ্রহণের চল শুরু হয়। এর পেছনে রয়েছে গল্পের মতোই এক কাহিনি। ৪০০ বছর আগের কিংবদন্তি। উত্তর প্রদেশের মৈথিলী ব্রাহ্মণ চন্দ্রমোহন ঠাকুর বেড়াতে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। ওড়াকান্দিতে এলে তাঁর সঙ্গে সেখানকার এক শূদ্র পরিবারের মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর প্রেম হয়। তাঁরা বিয়েও করেন। এ জন্য সমাজপতিদের রোষানলে পড়েন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। তবে তিনি না দমে পূর্ববঙ্গের শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। এই চন্দ্রমোহনেরই উত্তরপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তন করেন মতুয়া ধর্ম। তাঁর বংশধর ও অনুসারীরা এখন দুই বাংলায় ছড়িয়ে। বাংলাদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। তাঁদের নেতারা বলেছেন, তৃণমূলের প্রতি তাঁদের নৈতিক সমর্থন ছিল। কারণ দলটির প্রধান মমতা মতুয়া ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে এ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। নেতারা বলেন, তাঁরা মমতাকে ওড়াকান্দিতে দেখার অপেক্ষা করছেন। লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ গোবিন্দ চন্দ্র নস্কর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, 'মমতা ওড়াকান্দির কথা জানেন। তাঁর সেখানে যেতে অত্যন্ত আগ্রহ হওয়ারই কথা।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডানহাত বলে পরিচিত তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি মুকুল রায়ও মতুয়া ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। প্রসঙ্গত, মতুয়া ধর্মে দীক্ষা নিতে প্রথাগত ধর্মান্তরের দরকার নেই। যশোরের বেনাপোল থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা থেকে নয়জন ও পাশের নদীয়া থেকে অন্তত তিনজন মতুয়া বিধায়ক হয়েছেন। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই। এ ছাড়া বামদের মতুয়া প্রার্থী হরিপদ বিশ্বাস হেরে গেছেন। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের টিকিটে কোনো মতুয়া জয়ী হননি। গবেষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডেপুটি ডিন। কলকাতা থেকে গতকাল টেলিফোন করে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, 'এটা একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন। ১৯৪৬ সালের বিধানসভায় পূর্ববঙ্গীয় মতুয়াদের একটা উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। মাঝখানের ৫০-৬০ বছর খালি ছিল।' দুই বাংলার মতুয়াদের অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেতা হলেন 'বড়মা' বীণাপাণি দেবী। তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জিল কৃষ্ণ ঠাকুর এবার বিধায়ক হয়েছেন। রাজ্যভবনের শপথ অনুষ্ঠানে ৯৩ বছর বয়স্ক বড়মাও আমন্ত্রিত। অনেকে বলেন, হবু মুখ্যমন্ত্রী মমতার 'বিজয়লক্ষ্মী নারী' ফরিদপুরের বীণাপাণি দেবী। দেশ ভাগের অল্প আগে ওড়াকান্দির বাড়ি ছেড়ে স্বামী প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের (পিআর ঠাকুর) হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে আসেন বড়মা বীণাপাণি দেবী। ব্যারিস্টার পিআর ঠাকুর অবিভক্ত বাংলায় ফরিদপুর এলাকা থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। বিধান রায়ের আমলে তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রীও হন। কলকাতা থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠাকুরনগরের নাম তাঁর নামেই। বড়মার মতো বাংলাদেশি মতুয়াদের ছিলেন ছোটমা। ওড়াকান্দিতে ২০০৬ সালে ছোটমা মঞ্জুলিকা ঠাকুর মারা যান। তাঁরা দুজন সম্পর্কে জা। জানা গেছে, প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে ঠাকুরনগরে প্রায় ৩০ লাখ ও ওড়াকান্দিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়। বাংলাদেশের মতুয়া নেতারা মনে করেন, মমতা এখন তাঁদেরও নেত্রী। গতকাল কাশিয়ানী থেকে ফোনে প্রথম আলোর কাছে প্রতিক্রিয়া জানান কয়েকজন মতুয়া নেতা। মঞ্জিলের ভাইপো সুব্রত ঠাকুর এখন কাশিয়ানী উপজেলার চেয়ারম্যান। তাঁর বাবা প্রভাস চন্দ্র বাংলাদেশ মতুয়া মহাসংঘের মহাসচিব। এঁদের দুজন এবং ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বিধায়ক সচিপতি ঠাকুররের (৮০) সঙ্গে গতকাল কথা হয়। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, 'মমতার বিজয়ে আমরা গর্বিত ও আশান্বিত। এ জয় মমতার জয়, মতুয়াদের জয়, মর্যাদাহারা মানুষের জয়।' নমশূদ্র আন্দোলন বইয়ের লেখক অধ্যাপক শেখর মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এটা দারুণ চমকপ্রদ ঘটনা। ধর্মের ব্যাপার থাকায় বামেরা কখনো তফসিলি সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেনি। মমতা কমিউনিস্ট নন। তাই তিনি সহজে মতুয়া ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ সুরজিত দাশগুপ্ত বলেন, 'এখানে আধুনিক ও সনাতনী মতের দ্বন্দ্ব আছে। এটা ইতিবাচক নয়। সমাজ এর ফলে অতীতমুখী হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও এটা গরিবের ক্ষমতায়ন নয়।' ঠাকুরনগর ঘুরে মতুয়াদের নানা রকম উল্লেখযোগ্য স্থাপনা দেখা গেল। এর মধ্যে রয়েছে শানবাঁধানো কামনা সাগর (মতুয়াদের বিশ্বাস, এখানে স্নান করলে পাপমুক্তি হয়), মার্বেল পাথরের মন্দির। রেলস্টেশন থেকে মন্দির পর্যন্ত সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বড়মার কাছে মমতা প্রসঙ্গে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, 'মমতা মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, এটা খুবই ভালো। আমাদের উন্নতির জন্য তিনি অনেক করেছেন। উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের আগে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিত। ওরা (তীর্থযাত্রী) বলত, "ট্রেনে আমাদের উঠতে দেয় না।" এই অন্যায়ের অবসান ঘটেছে।'
আগে তিনি ছিলেন শুধুমাত্র মতুয়া মহাসঙ্ঘের সহ সঙ্ঘাধিপতি। কিন্তু এখন রাজনীতিতেও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের। সঙ্ঘের পদাধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি এখন রাজ্যের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। মতুয়া মহাসঙ্ঘকেও নিজের মতো ঢেলে সাজতে চাইছেন। এত দিন ধরে সঙ্ঘের সাধারণ সভায় কার্যকরী কমিটি ঘোষণা করতেন সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা মঞ্জুলকৃষ্ণের দাদা কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। সর্বসম্মতিক্রমে সেই নামের তালিকাই গৃহীত হত। কিন্তু এ বার বেঁকে বসেছেন মঞ্জুল। নিজেও তালিকা হাজির করেছেন। যা নিয়ে দুই ভাইয়ের কোন্দল প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বিষয়টি গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত।
একই মঞ্চে এক সঙ্গে নামের তালিকা প্রকাশ করছেন মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ও কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। বৃহস্পতিবার পার্থসারথি নন্দীর তোলা ছবি।
বৃহস্পতিবার ছিল সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিটির ২৫ তম বার্ষিক সাধারণ সভা। প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার এই দিনটিতে মতুয়াদের পীঠস্থান গাইঘাটার ঠাকুরনগরে সভা হয়। সেখানে নতুন কার্যকরী কমিটির সদস্যেরা মনোনীত হন। গত কয়েক বছরের মতো এ বারও মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইকে নাম ঘোষণা করছিলেন কপিল। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আসে প্রথমেই। একে একে পৃষ্ঠপোষক পদে তিনি পড়তে থাকেন বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ গোবিন্দচন্দ্র নস্কর, হাবরার বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মঞ্জুলকৃষ্ণদের নাম। বেলা তখন প্রায় ১২টা। হঠাৎই এক দল অনুগামীকে নিয়ে সভাস্থলে আসেন মঞ্জুল। উঠে পড়েন মঞ্চে। কাগজ দেখে তিনিও পড়তে শুরু করেন তাঁর মনোনীত কমিটি সদস্যদের নাম। সামনে মাইক্রোফোন ছিল না। খালি গলাতেই চিৎকার করছিলেন মঞ্জুল। এক অনুগামী মাইক এগিয়ে দেন। দুই ভাই মাইকে তারস্বরে চেঁচিয়ে নামের তালিকা পড়তে থাকেন। দু'পক্ষের অনুগামীদের মধ্যে তখন তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে মঞ্চের নীচে। অশক্ত শরীরে বড়মা উঠে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করেছিলেন দুই ছেলেকে শান্ত করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দু'পক্ষ পাঠ শেষ করে নেমে যায় মঞ্চ থেকে। কপিল পরে বলেন, "যা হয়েছে গায়ের জোরে। এটা অন্যায় ও অনৈতিক। আমি সঙ্ঘাধিপতি। আমি যেটা ঘোষণা করেছি, সেটাই আসল কমিটি।" রাতের দিকে কপিল পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, মঞ্জুল তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, "লিখিত অভিযোগ হয়েছে। আমরা আইনমাফিক তদন্ত করছি।" এ দিনের ঘটনায় মঞ্জুল সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। সাধারণ সভায় গোলমালের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কটূক্তিও করেন তিনি। দিনভর টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়নি তাঁর সঙ্গে। দৃশ্যতই বিরক্ত বড়মা শুধু বলেন, "কমিটি গঠন স্থগিত। আপাতত পুরনো কমিটিই বহাল থাকল।" মতুয়া মহাসঙ্ঘের অন্দরে কপিল-মঞ্জুল দুই ভাইয়ের আকচা-আকচি নতুন ঘটনা নয়। ভক্তেরা সে ব্যাপারে সম্যক ওয়াকিবহাল। কিন্তু হঠাৎ সেই তিক্ততা এমন প্রকাশ্যে চলে এল কী করে? মতুয়া ভক্তদের একাংশ জানাচ্ছেন, মঞ্জুল আপাতত মতুয়া মহাসঙ্ঘকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজতে চাইছেন। একদা 'বামঘনিষ্ঠ' বলে পরিচিত কপিল বিধানসভা ভোটের কিছু আগে থেকেই বামেদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। ইদানীং তাঁকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই ওঠাবসা করতে দেখা যাচ্ছিল। তৃণমূল শিবিরে ঢুকে পড়ে দাদার এই 'খবরদারি' না-পসন্দ মঞ্জুলের। কপিলবাবুর পেশ করা তালিকায় নাম আছে জগদ্দলের প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক হরিপদ বিশ্বাসেরও। তিনি বলেন, "মতুয়াদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব ঢুকে পড়ছে। সঙ্ঘের বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।" অন্য দিকে, জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কথায়, "যা হয়েছে তা মতুয়া মহাসঙ্ঘের নিজেদের ব্যাপার। আমাদের সরাসরি কিছু বলার নেই। তবে মঞ্জুল আমাদের মন্ত্রিসভায় আছেন। স্বভাবতই আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নৈতিক সমর্থন ওঁর দিকেই থাকবে।" http://www.anandabazar.com/archive/1111111/11pgn1.html
লক্ষ্য পঞ্চায়েত, মন্ত্রিসভায় বড় ঝাঁকুনি মমতার
আনন্দবাজার – বৃহস্পতি, ২২ নভেম্বর, ২০১২
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ এনে এবং বড়সড় রদবদল ঘটিয়ে সরকার পরিচালনায় একটা ঝাঁকুনি দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ঠিক আগের দিন, মঙ্গলবার বেশ ক'টি দফতরে আমলাস্তরেও অদল-বদল করেছেন তিনি। রাজ্যের প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটকে পাখির চোখ করতেই মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন তৎপরতা। বুধবার রাজভবনে ১৩ জন মন্ত্রী শপথ নেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে। এঁদের পাঁচ জনের পদোন্নতি পেলেন, বাকি আট জন মমতা মন্ত্রিসভায় প্রথম। এ ছাড়া বর্তমান ৮ মন্ত্রীর দায়িত্ব বদলও হয়েছে। যাঁরা নতুন এলেন ও যাঁদের পদোন্নতি হল, তাঁদের সিংহভাগই গ্রাম-বাংলার, যার মধ্যে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি মুর্শিদাবাদ-মালদহের পাশাপাশি ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে সিপিএমের দখলে থাকা বর্ধমানও রয়েছে। উপরন্তু যে জেলা পরিষদগুলোয় তৃণমূল সামান্য ব্যবধানে হেরেছিল, সেই সব জেলাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন, নদিয়ার পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা হয়েছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরির প্রতিমন্ত্রী। উল্লেখ্য, নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা আর্সেনিক-সমস্যায় জর্জরিতও বটে।
ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধি মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রীর পদে উন্নীত হয়েছেন। যার পিছনে উত্তর ২৪ পরগনায় বিপুলসংখ্যক মতুয়া ভোট ধরে রাখার উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে অনুমান। সেচ-খালের বেহাল দশার কারণে যে জেলার গ্রামীণ এলাকা ফি বছর ভেসে যায়, সেই হাওড়ার রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় (ডোমজুড়ের বিধায়ক) হয়েছেন সেচ-জলপথের নতুন পূর্ণমন্ত্রী। আবার যেখানকার জেলা পরিষদ কব্জায় থাকলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূল জেরবার, সেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুই বিধায়ককে নতুন প্রতিমন্ত্রী করেছেন মমতা। এঁরা হলেন কাকদ্বীপের মন্টুরাম পাখিরা ও মগরাহাটের গিয়াসুদ্দিন মোল্লা। নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ওই জেলারই শ্যামল মণ্ডলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে জেলাবাসীকে 'সততা ও স্বচ্ছতা'র বার্তাও দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। সিঙ্গুর-আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা বেচারাম মণ্ডলও এ বার মমতা মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ।
কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর খাসতালুক মুর্শিদাবাদ থেকে দলত্যাগী হুমায়ুন কবীরকে প্রতিমন্ত্রী করে আনা হয়েছে। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তিনিই যে অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের 'মুখ' হবেন, এ দিন শপথ গ্রহণের পরে সে ইঙ্গিত দিয়ে হুমায়ুন বলেন, "অধীর চৌধুরী যদি বহরমপুরের হয়ে থাকেন, তবে মনে রাখবেন আমি রেজিনগরের হুমায়ুন কবীর। দিদির আশীর্বাদ নিয়ে লড়াইয়ের মাঠে নামছি। এক ইঞ্চি জমি ছাড়ব না।" ওই জেলার সুব্রত সাহাও প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন।
রাজনীতির তাগিদে কংগ্রেসের ঘাঁটি মালদহও রদবদলে গুরুত্ব পেয়েছে। একদা গনি-ঘনিষ্ঠ এবং কংগ্রেসত্যাগী সাবিত্রী মিত্রকে মমতা আগেই ক্যাবিনেট মন্ত্রী করেছিলেন। এ বার কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর মতো মালদহের ডাকাবুকো নেতাকেও কংগ্রেস থেকে এনে মন্ত্রী করেছেন মমতা। কলকাতাকে লন্ডন ও দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ড বানানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর উপরেই বর্তেছে। কৃষ্ণেন্দুকে জায়গা করে দিতে বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহকে ঠেলা হয়েছে 'পরিকল্পনা' দফতরে, যা এত দিন দেখতেন বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। 'শস্যভাণ্ডার' বর্ধমানে সিপিএম-কে চাপে ফেলতে স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তির ও 'আদি তৃণমূল' স্বপন দেবনাথকে করা হয়েছে ভূমি দফতরের প্রতিমন্ত্রী।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে কৃষি দফতরকে আরও সচল করতে মমতা দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিক মলয় ঘটককে। মলয়বাবুর কাছ থেকে আইন দফতর নিয়ে তার স্বাধীন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে। আর কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে আনা হয়েছে পরিসংখ্যানে। এই দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ হয়েছেন নতুন মৎস্যমন্ত্রী। পরিবহণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী মদন মিত্র পূর্ণমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন। আবাসন-যুবকল্যাণের প্রতিমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও তা-ই। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানমন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস হয়েছেন কারিগরি-শিক্ষামন্ত্রী।
তবে কিছু প্রশ্নও মাথা চাড়া দিয়েছে রাজনীতিক-প্রশাসনিক মহলে। যেমন, পরিবহণে নানা বিতর্কিত বিষয়ের সমাধানে ব্যর্থ মদন মিত্রকে কেন পূর্ণমন্ত্রী করা হল? কৃষিতে ঘুঘুর বাসা ভাঙার পরেও রবীন্দ্রনাথবাবুকে কম গুরুত্বের দফতরে পাঠানোর কারণ কী? বেচারামবাবুকে কৃষি এবং আইসিডিএস প্রকল্পের প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কোন সাফল্যের সুবাদে অরূপ বিশ্বাস পূর্ণমন্ত্রী হলেন? উপরন্তু মমতা নিজেই যেখানে কারিগরি-শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন, সেখানে দু'বার দফতর বদলানো উজ্জ্বলবাবুকে নিয়ে আসাটাও অনেককে ধন্ধে ফেলেছে। দুবরাজপুরে লোবা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরেও চন্দ্রনাথবাবুর গুরুত্ব বাড়ানোটা দলের অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। "ওঁর জোরে বীরভূম জেলা পরিষদ সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা যাবে তো?" সংশয় প্রকাশ করেন বীরভূমের এক তৃণমূল বিধায়ক। প্রশ্ন উঠেছে চন্দ্রিমাদেবীর শপথ নিয়েও। তিনি আগেও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, এখন তাঁকে স্বাধীন দায়িত্ব দেওয়া হল। এ জন্য তাঁকে এ দিন ফের শপথবাক্য পাঠ করানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না বলে দাবি করেছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম।
কবিগানের আসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢুকে পড়েছেন 'ঋষিকবি' হিসেবে। কবির লড়াইয়ে অবতীর্ণ দুই কবি তখন সবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের কিছু ঘরবাড়ি, লোকবসতির বিচ্ছিন্ন কয়েকটি পাড়া, বাঁশের সাঁকো আর বিস্তীর্ণ ফসল কাটা মাঠ পেরিয়ে জিকাবাড়ি গ্রামের শেষ সীমান্তের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরসংলগ্ন খেলার মাঠে পৌঁছালাম। সেখানে কবিগানের আসর বসেছে। দেখি, গ্রামের কিছু সাধারণ মানুষ—যাঁরা মূলত কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, ক্ষুদ্র পেশাজীবী এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের লোক; তাঁরা কবিগানের কবি-সরকার, দোহার ও বাদ্যযন্ত্রীদের কেন্দ্রে রেখে গোল হয়ে বসে কবিগান উপভোগ করছেন। কবি-সরকার ও দোহারদের সুরে-কথায়, ঢোল-কাঁসর-ঘণ্টার তাল-ধ্বনিতে, হারমোনিয়াম-বাঁশির সুরের ইন্দ্রজালে কবিগান এগিয়ে যেতে থাকে। আসরের নিয়মানুযায়ী দুই দল কবি-সরকার যথাক্রমে ডাক, মালসী, সখীসংবাদ, ধরন, পাড়ন, মিশ, মুখ, টপ্পা, ফুকার ইত্যাদি পর্বের গানের সুর-বাণীর মধ্যে সরসিক ও জ্ঞানগর্ভ কথার ঝলকানিতে প্রতিমুহূর্তে দর্শক-শ্রোতাদের বিস্ময়ে ফেলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের বিস্ময়ের তখনো বোধ করি বেশ বাকি। কেননা, আমরা নাগরিক পরিমণ্ডলের মানুষ, চলমান জীবনবাস্তবতায় ও যুক্তির নিষ্ঠুরতায় সহজে বিস্মিত হতে ভুলে গেছি। সেদিন কবিগানের আসরে আলোচনার বিষয় ছিল কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, স্থানীয়দের ভাষায় যে বিষয়বস্তুটি 'গৌরাঙ্গলীলা' বা 'গৌরলীলা' নামেই অধিক পরিচিত। আসরে একপক্ষের কবি-গায়ক সদানন্দ সরকার বিপক্ষের কবি নারায়ণচন্দ্র বালার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রাধা-কৃষ্ণের স্বরূপ সম্পর্কে। গানের ভাষায় বলেছিলেন, 'রাধা কী? আর কৃষ্ণ কী? করো ইহার স্বরূপ ব্যাখ্যা।' জবাবে প্রতিপক্ষের কবি-সরকার নারায়ণচন্দ্র বালা বলেন, 'কথাটা শক্ত। তাই একটু ভেঙে বলি, সহজ করে বলি। 'আপনারা আমার কথা মানবেন কি না জানি না, তবুও বলি—আসলে, ভক্ত জন্ম নেয়ার পরেই তো ভগবান—এই জন্য যদি বলা হয়—ভক্ত আগে, ভগবান পরে—কথাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়। জানি আপনারা বলবেন—ভগবান আগে ভক্ত পরে, আপনাদের কথাটা মেনে নিয়েও বলি—ভগবান আগে ঠিক আছে—কিন্তু ভক্ত হবার পরেই তো ভগবানকে জগৎ চিনল—মানুষ চিনল। 'কৃষ্ণ আগে একা ছিলেন—নিজের শরীর নিজে স্পর্শ করছিলেন। কিন্তু কেন? নিজের অন্তরে সুপ্ত আনন্দ কত—তা আস্বাদনের জন্যই—গোবিন্দ নিজের শরীর নিজে স্পর্শ করছিলেন। কিন্তু সুখ পাচ্ছিলেন না। অমনি চিন্তা করে, মনে মনে নিজের অন্তরস্থ সুপ্ত আনন্দ-রসধারা আস্বাদনের জন্য—নিজে হয়ে দ্বিভাগাকৃতি—অর্থাৎ অর্ধেক অঙ্গে সৃষ্টি করলেন রাধা। 'বৈষ্ণব সাহিত্যে বলেছে, "এক দেহেতে হয় না কভু রস আস্বাদন। ভিন্ন দেহ তাহার লাগি হল প্রয়োজন।" ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর তেজস্বী লেখনী ধরেছেন এখান থেকে—"যখন তুমি আপনি ছিলে একা। আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা"।' আমাদের বিস্ময়ের শুরু এখান থেকে। কারণ, কবিগানের আসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢুকে পড়েছেন 'ঋষিকবি' হিসেবে। আর সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হলো রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের চরণ—তবে, তা কিছুটা পরিবর্তিত রূপে। আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, এই পরিবর্তনটি ঘটেছে বাংলার মুখরা তথা মৌখিক-সাহিত্যের চিরায়ত নিয়মানুযায়ী। এখানে আমরা স্পষ্ট মনে করতে পারি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সেই খেদ, 'আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।' কবিগানের আসরে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই খেদ তাৎক্ষণিকভাবে অমূলক মনে হয়। কেননা, কবি-সরকার রাধা-কৃষ্ণের স্বরূপ ব্যাখ্যার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্য থেকে বাণী-বাক্য ধার করে বলে চলেন, 'যখন তুমি আপনি ছিলে একা। আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা।' কী সুন্দর কথা! ওই যে, নিজের শরীর নিজে স্পর্শ করে আনন্দ হচ্ছিল না—কবি যে এখানে সে কথাই বলছেন। আসলে কি জানেন, অন্যের স্পর্শ বড় মধুর লাগে, তা নারী হলে আরও মধুর লাগে। তাই তো ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের কথা, 'যখন তুমি আপনি ছিলে একা। আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা। আমি এলাম, ভাঙল তোমার ঘুম, শূন্যে শূন্যে ফুটল আলোর আনন্দ-কুসুম। আমি এলাম, কাঁপল তোমার বুক। আমি এলাম, এল তোমার দুখ। আমি এলাম, এল তোমার আগুনভরা বসন্ত। আমার মুখ চেয়ে, আমার পরশ পেয়ে—যুগে যুগে আপন পরশ পেলে।' 'আমি এলাম, তাই তো তুমি এলে।' কী মধুর কথা! এই জন্য রাধা না এলে কৃষ্ণকে কেউ চিনত না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ১১ মার্চ ২০০৭ সালে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার জিকাবাড়ি গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় অনুষ্ঠিত কবিগানের আসর থেকে ধৃত কবি-সরকারের কথার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের ২৯ সংখ্যক কবিতাটি অনেকটাই পরিবর্তিত এবং সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আর এই পরিবর্তন এবং সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা দৃষ্টান্তের ভেতর দিয়েই জনমানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃজনকর্ম গৃহীত হওয়ার একটা জলজ্যান্ত ইতিহাস প্রত্যক্ষ করা গেল। পরদিন ১২ মার্চ জিকাবাড়ি গ্রামের ভূপতি মোহন বালার ঘরে গ্রামীণ আসরে রবীন্দ্রনাথের কাব্য উপস্থাপনকারী কবি-সরকার নারায়ণচন্দ্র বালার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, 'আমাদের একটা ধারণা ছিল যে, কবি-সরকাররা শুধু শাস্ত্রীয় গ্রন্থই পড়েন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে শাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করেন কীভাবে?' নারায়ণচন্দ্র বালা বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ তো শাস্ত্রের বাইরে নয়, তাঁর প্রতিটি কবিতার দুটো দিক। একটা সাধারণের জন্য, আরেকটা যারা অধ্যাত্মবাদী বা অধ্যাত্মচেতনা সমৃদ্ধ জীবন যাপন করে তাদের কবিগানের আসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢুকে পড়েছেন 'ঋষিকবি' হিসেবে। দুটো-তিনটে দিক থাকে কবির কথায়। এর মধ্যে আধ্যাত্মিকতা তো আছেই।' 'কিন্তু যে দর্শকদের সামনে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করলেন সেই দর্শকদের অধিকাংশই দেখলাম গ্রামের সাধারণ মানুষ।' নারায়ণচন্দ্র বালা বলেন, 'আপনি ভাবছেন, তারা হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে—অনুভূতি আর অনুমিতি দুটো জিনিস আছে। এই বিবেচনা মাথায় রেখেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে আসরে হাজির করি, দুর্বোধ্য জায়গাটা সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। তখন মানুষের ভালো লেগে যায়। গতবার ওই কচুয়া থানায় (বাগেরহাট) দুই পালা গান এক জায়গায় হয়েছিল। সেখানে অন্তত বিশজন উকিল ছিল। গানের শেষে এক উকিল এসে আমাকে বলেন—"নারায়ণ কাকু, আপনি যে ভাবভাষা ব্যবহার করেন, তা এই কবিগান যারা শুনতি আসে এরা কি বোঝে? আপনি বলেন কেন? আপনার ব্যর্থ চেষ্টা"।' 'আমি উনাকে জবাব দিয়েছিলাম—কাকাবাবু, কথা ঠিকই বলেছেন, আমি তো মানুষকে শোনাই না, আমি নিজে শুনি। আমার যদি ভালো লাগে, আমার যদি পরানে বেদনা আসে, তাহলে কে শুনল না-শুনল তাতে কিছু যায়-আসে না। উনি বললেন, "আমার উত্তর পেয়ে গেছি"।' এ পর্যায়ে আমরা নারায়ণচন্দ্র বালাকে বলি, 'আপনাদের ওপর রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক প্রভাবটাই বেশি। আসরে দেখা যায়, আপনারা রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান-এর গানগুলো ব্যবহার করেন এবং রবীন্দ্রনাথকে ঋষিকবি বলেন। এসবের ভেতর দিয়ে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, আপনারা রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে, আপনার নিজের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আত্তীকরণের সূচনা হয়েছিল কবে এবং কীভাবে?' প্রত্যুত্তরে নারায়ণচন্দ্র বালা বলেন, 'আমি ক্লাস নাইনে পড়ার সময় উনার গীতাঞ্জলিটা দেখেছিলাম। আমি তখন সব বুঝতামও না ভালো। আমার বাড়ির পাশে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। যখন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গানগুলো বলতেন তখন খুব আপ্লুত হতাম এবং প্রবল ইচ্ছা জাগত যে, আমি রবীন্দ্রনাথের সব পড়ব। কিন্তু এটা তো বাতুলতা। উনি এক জীবনে যা লিখেছেন, একটা মানুষ বোধহয় এক জীবনে তা পড়ে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু গীতাঞ্জলি আমি অনেকবার পড়েছি। তার সাথে গীতবিতান। তা…ওই গানটি আমার এত সুন্দর লাগে যে, প্রতিটি গানে একটা আধ্যাত্মিক চেতনা জড়িত। আর যদি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করে কেউ, তাও হতে পারে, সবার মনের সাথে যেন মিলে যায়, কিন্তু আমার বিরহব্যঞ্জনা থেকে ওই আধ্যাত্মিক চেতনা বেশি ভালো লাগে। উনার গানের মধ্যে তা আমি দেখতে পাই—এটা হয়তো আমার ভুলও হতে পারে দেখা, কিন্তু আমার সেভাবেই মনটা গড়েছে, উনার উপর (রবীন্দ্রনাথের গানের আধ্যাত্মিক চেতনার উপর) দারুণ আকৃষ্ট আমি। যিনি আমাকে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি বুঝিয়েছিলেন উনার নাম ছিল মুকুন্দবিহারি বাওয়ালী। উনার পরিচয়? উনি একজন সাধারণ মানুষ, অল্প লেখাপড়া জানতেন, কিন্তু আধ্যাত্মিক চিন্তায় সমন্বিত মানুষ। উনি আমাকে বোঝাতেন এবং নির্ভুল তথ্য দিতেন। খুব চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।' আমরা প্রশ্ন করি, 'আপনারা তো রবীন্দ্রনাথ, লালন, বিজয় এঁদের গীত-বাণী ব্যবহার করেন। এঁদের মধ্যে কি কোনো সাদৃশ্য আছে?' নারায়ণচন্দ্র বালা বলেন, 'পার্থক্য, সাদৃশ্য সবই আছে। তবে তার মধ্যে আছে প্রকাশের বা ব্যঞ্জনার যে সৃষ্টিশৈলী তা তো সবার এক রকমের না। যিনি যতটা আধ্যাত্মিক চেতনায় সমন্বত, তার প্রকাশটা তত সুন্দর।…রবীন্দ্রনাথকে আপনারা রোমান্টিক মাধুর্য দিয়ে বিবেচনা করেন, ঠিক আছে, কিন্তু যখন আমি তাঁর গানে শুনতে পাই "দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে/আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে"—এ যে কত বড় কথা, একবার ভেবে দেখেন—"আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে"। এইখানে এসে যে আমি আর স্থির থাকতে পারি না। আমার চোখ ভেঙে জল চলে আসে। "আমি পাই নে তোমারে…"।' নারায়ণচন্দ্র বালা এখানে এসে তাঁর কথা আর শেষ করতে পারেন না। আমরা লক্ষ করি, তাঁর দুই চোখ ভেঙে জলের স্রোতধারা বেয়ে পড়ছে। আর তিনি হু হু করে কেঁদে চলেছেন। নারায়ণচন্দ্র বালার এই কান্নার সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে আমরা মিল খুঁজে পাই কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার নোয়াবাদ-জাফরাবাদ গ্রামের রামমঙ্গলের গায়ক-পালাকার গোপালচন্দ্র মোদকের কান্নার। একদিন তিনি তাঁর রামমঙ্গলের আসর শেষে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' গেয়ে উঠলেন। কিন্তু গানের সুর-বাণীর মধ্যে যখন তিনি 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি'র স্থানে পৌঁছালেন, তখন তিনি 'হায় হায়' করে বেদনায় মুষড়ে গিয়ে সত্যি সত্যি 'নয়ন জলে' ভেসে গেলেন। সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে স্কুলজীবনে ক্লাস শুরুর আগে প্রায় প্রতিদিন একবার করে গেয়েছি এই জাতীয় সংগীত, এখনো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বা প্রয়োজনীয় স্থানে কমবেশি গেয়ে থাকি, কিন্তু 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি'র স্থানে এসে তো কোনো দিন কেঁদে ওঠার প্রয়োজন বোধ করিনি, বা সেই কেঁদে ওঠার অনুভূতিটাও কোনো দিন আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি। কিন্তু কেন হয়নি? রামমঙ্গলের আসরে বসে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি। আরে তাই তো—মাতৃসম দেশ বন্দনার এই গানটির মর্ম না বুঝেই তো আমরা এত দিন তোতাপাখির মতো গেয়ে চলেছি। অথচ এর মর্মবস্তু বুঝলে—আমাদেরও তো গোপালচন্দ্র মোদকের মতো কান্না করার কথা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা। আমাদের দেশমাতৃকার বদন আজ শুধু মলিন নয়, বহুবিধ রাজনৈতিক, ধর্মীয় টানাপোড়েন এবং নয়া উপনিবেশবাদী চক্রান্তে বিপন্ন বটে, কিন্তু কোনো বঙ্গমায়ের সন্তানকে তো দেশমাতৃকার এই বিপন্নতার মধ্যে গোপালচন্দ্র মোদকের মতো কাঁদতে দেখছি না। তবে কি আমরা গোপালচন্দ্র মোদকের মতো আমাদের বৃহত্তর জাতিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকৃত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' গানের বাণীকে প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করে নিতে পারিনি? ভেবে অবাক হই, জনমানুষের কাছে কত সহজেই না রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর গভীরতা অনুভূত হয়!
এক অদ্ভুত দেশ ভারত। প্রতি বছর ভারতে গিয়ে দেখি নতুন নতুন বিজ্ঞান প্রযুক্তি সংস্থা যেমন খুলছে-পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন্দির। এই মোড়ে মা শীতলার গরম মাথা ঠান্ডা করতে কোমরে জলের ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহিলাদের দল- আর রাস্তার অন্য মোড়ে শনির কুদৃষ্টি আটকাতে ঢং ঢং ঘন্টা। কুড়ি বছর আগে এসব কিছু ছিল না। এটা হয়েছে ভারতের সর্বত্রই-পশ্চিম বঙ্গে কমিনিউস্ট শাসিত বাম সরকার থাকা সত্ত্বেও প্রগতিশীলতার কিছুই চোখে পড়বে না সাধারন মানুষের মধ্যে। ওরা একই সাথে শনির মন্দিরেও গিয়ে থাকে- আবার সিপিএমের সদস্যও। আরো অদ্ভুত দৃশ্য মহিলাদের মধ্যে। একই সাথে তারা ডিসকোথেকে পিঠ খুলে শীলা -কি জওয়ানী ছোঁয়ার চেষ্টা করছে আর তার পরের দিন উপোস করে ব্রত উদযাপন।
ভাবার চেষ্টা করা যেতে পারে সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এমন আচরনের কারন কি?
আমি তিন বছর আগে, মানুষের ধর্মাচারন কেন সামাজিক উপযোগিতা নির্ভর তার ওপর একটা লেখা লিখেছিলাম। বর্তমান প্রবন্ধটি বুঝতে গেলে, আগের লেখাটি পড়ে নিলে সুবিধা হবে। স্যোশাল ইউটিলিটির তত্ত্বের মূল বক্তব্য মানুষের ব্যাবহারগুলি এক অদৃশ্য "সামাজিক" বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সেই বাজারের পণ্য হিসাবে সে নিজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে ।
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ব্যাপারটা সমাজ বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ন বিষয়। কারন মানুষের সামাজিক ব্যাবহারগুলির মূলে এই স্যোশাল ইউটিলিটির তত্ত্ব। প্রথমেই সেই সব মেয়েদের বা আরো প্রিসাইজলি সেই সব বৌদের কথাতে আসি যারা একই সাথে ডিসকোথেক আর ব্রত নিয়ে ব্যাস্ত। সামাজিক কারনেই সব বৌদের দুটো সার্কল থাকে-একটা সমবয়সীদের সার্কল-অন্যটা শাশুড়ি বা মা, মাসীদের সার্কল। তারা দুটো সার্কলেই জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। ব্যাবসায়ীদের মধ্যেও আমরা একই জিনিস দেখব। সমাজে গ্রহণযোগ্য হওয়ার দায় তাদের মধ্যে অনেক বেশী। কারন ব্যাবসার মূল ভিত্তিই গ্রহনযোগ্যতা।
আজ থেকে দুশো বছর আগে, যেখানে প্রযুক্তির উন্নতি হয় নি এবং যৌথ উৎপাদন ব্যাবস্থাতেই সমাজ চলেছে-সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার মধ্যে কোন পরস্পর বিরোধি দ্বন্দ ছিল না-কারন সমাজের বিবর্তন হয়েছে খুব ধীর গতিতে। শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ব্যাবস্থা সামাজিক শক্তির কেন্দ্রগুলি থেকে মুক্ত হতে থাকে এবং ভেঙে পরে যৌথ পরিবার ব্যাবস্থা। ফলে সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য না হয়েও বেঁচে থাকার পথ পরিস্কার হয়। নারীবাদ থেকে বস্তুবাদি সমাজতান্ত্রিক ধারনা বা যা কিছুকে আমরা প্রগতিশীল চিন্তা বলে মনে করি, তার ভিত্তিপ্রস্তর এই সমাজ নিরেপেক্ষ উৎপাদন ব্যাবস্থা, যা উন্নত প্রযুক্তির দান।
উদাহরন দিচ্ছিঃ তামিলনাডু বা বাংলাদেশে সব পরিবারেই ধর্মের খুব প্রাবল্য। আজ থেকে দুশো বছর বাদে যদি সেখানে কোন তরুণের মধ্যে ঈশ্বরে অবিশ্বাস জন্মাত-তার হাল কি হত?
তার পারিবারিক ব্যাবসা বা জমি থেকেই তার ভরনপোষন হত বলে, তার পরিবারের ধার্মিক আচরনকে সে মেনে নিতে বাধ্য হত। সেটাই সামাজিক বাধ্যবাধকতা। কিন্ত আজকের দিনে ছেলেটা ভাল পড়াশোনা করে সফটোওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সে পৃথিবীর যেকোন উন্নত শহরে নিজের মতন থাকতে পারে। এটি মেয়েদের জন্যে আরো অধিক সত্য। দুশ বছর আগে নারীবাদিই হও আর ঘাসীবাদিই হও পরিবার জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিত। আজকের মেয়েটি কিন্ত পড়াশোনা করে নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে। এবং সে যে এটা পারে- এর মূলে কোন নারীবাদি আন্দোলন নেই-আছে উৎপাদন ব্যাবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন যার কারনে সে স্বাধীন ভাবে চাকরী করতে পারে এবং তার সব কিছু চাহিদাই পেশাদারি ভাবে সমাজ মেটাতে সক্ষম। উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যাবস্থা এই সমাজ নিরেপেক্ষ জীবনকে বাস্তবায়িত করেছে।
এতগুলো কথা লিখতে হল এটা বোঝানোর জন্যে আমাদের সামাজিক ব্যাবহারগুলি উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে আছে। ধর্মও একটি সামাজিক ব্যাবহার যা উৎপাদন ব্যাবস্থা বহির্ভূত কিছু নয়। উৎপাদন ব্যাবস্থা যত সমাজ নিরেপেক্ষ হবে, কোন ধর্মীয় ক্লাবে যোগ দেওয়ার চাপ কমবে!
(২) ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আমি ধর্মীয় ক্লাব বলি। বাঙালী হিন্দুদের অনেক ধর্মীয় ক্লাব আছে- রামকৃষ্ণ মিশন, মতুয়া, ইস্কন, বাবা লোকনাথ, বাবা অনুকুল ঠাকুর ইত্যাদি। মুসলমানদের ও অজস্ত্র ক্লাব আছে-তবলিগী, জামাত ( জামাতের মধ্যেও অনেক ভাগ) , আতাহারি, আগাখান -শেষ নাই। খ্রীষ্ঠান চার্চের সংখ্যাও অজস্র।
এবার আমরা যে প্রশ্নটা করব -একটা লোক এই সব ক্লাবের মেম্বার হতে চাইছে কেন? এর পেছনে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ভূমিকা কি? যারা আগাখানের শিষ্যদের সাথে মেলামেশা করেছেন-দেখবেন তাদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন "গর্ব" আছে যে তারা "উৎকৃষ্ট" ইসলামিক ক্লাবের মেম্বার। বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের "ভক্তদের" মধ্যেও দেখবেন নাক উঁচু ভাব আছে। এই সব ক্লাবগুলির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় আমাদের সমাজে এই ক্লাবগুলির গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্তদের মধ্যে উচ্চশ্রেনীর বাঙালী বেশী নজরে আসবে যেখানে বাবা লোকনাথের শিষ্য আমজনতা। এগুলো খুব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়-যেখন রাষ্ট্রশক্তি কোন একটা গোষ্টিকে বেশী নিরাপত্তা এবং অন্য একটি গোষ্টিকে উৎপাত করা শুরু করে। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্যে জনগন গোষ্টি বদল করে-বা নিরাপদ গোষ্টির মেম্বারশিপ নিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
দুটো উদাহরন দেওয়া যাক। প্রথমেই পশ্চিম বঙ্গে সিপিএমের মেম্বারশিপ নিয়ে একটু আলোচনা করি। সিপিএমের মধ্যগগনে রাম শ্যাম যদুমধু -সবাই সিপিএমের মেম্বার ছিল। সিপিএম [ বা গ্রামের ভাষায় ছিপিএম] না করলে রেশন থেকে শুরু করে কোন সরকারি সাহায্য পাওয়া যেত না। জায়গা জমি সব কিছুই লোপাট হয়ে যেতে পারত। ফলে মনসাসেবক থেকে শিবসেবক, জামাত থেকে ওয়াহাবি মুসলিম সবাই এই কমিনিউস্ট ক্লাবের সদস্য হয়। আবার এবার সিপিএম ভোটে গোহারা হারলে তাদের অনেকেই তৃণমূল ক্লাবে চলে যাবে। বা অনেকেই সময় বুঝে চলেও গেছে।
বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যালোপের পেছনেও একই ব্যাপার কাজ করেছে। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে ইসলাম ছাড়া কোন ধর্মের নিরাপত্তা সুরক্ষিত নয়া। ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্টিগুলি-যা হিন্দুই হোক বা আহমেদিয়াই হোক বা বাহাই হোক-আস্তে আস্তে দুর্বল হয়েছে।
অন্যদিকে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাতেও ধর্মীয় সম্প্রদায় ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রতি এরিজনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড উইগনারের প্রকাশিত একটি গবেষনাপত্রে- উনি দেখিয়েছেন কি করে উন্নত বিশ্বে ধর্ম বা ধর্মাচারন বা এই সব ধর্মীয় ক্লাবগুলির সদস্য হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এবং তাদের নন লিনিয়ার মডেল দেখাচ্ছে -উন্নত বিশ্বে ধর্ম এই শতাব্দিতেই লুপ্তপ্রায় হবে।
এক্ষেত্রে আসলে উলটো ব্যাপার ঘটেছে। এখানকার উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থার বস্তুবাদি সুবিধা নিতে গেলে ধর্মীয় ক্লাবের মেম্বার হওয়াটা কোন কাজে আসে না-ধনতন্ত্রে প্রতিভা এবং অভিজ্ঞতাই শেষ কথা। ধর্মীয় আচরন বরং উন্নত বিশ্বে উন্নতির অন্তরায়। যেমন নাস্তিক বলে, আমেরিকান বা বৃহত্তর বাণিজ্যিক গোষ্টির কাছে আমি অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য [ অবশ্য আমি সে জন্যে নাস্তিক না-ঈশ্বরের বিশ্বাস করার কোন কারন খুঁজে পায় নি কোনদিনই!] যেটা হিন্দু হলে অসুবিধা হত। অধিকাংশ আমেরিকান ধরে নেয় হিন্দু মানে তৃণভোজি-তাদের সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়া বিড়াম্বনা। এগুলো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরিপন্থী। সেটাও আসল কারন না । আসলে ধর্মে বিশ্বাস নেই বলে, সব সিদ্ধান্ত নিতে, নিজের বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখতে আমি বাধ্য। ঈশ্বরের ওপর ত কিছু ছাড়তে পারি না-ভাগ্যের হাতেও না। ফলে চোখ কান অনেক খোলা রেখেই যেকোন জিনিস বোঝার চেষ্টা করাটাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। এই যুক্তিবাদি মন ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থার উৎপাদন কাঠামোতে অনেক সুবিধা দেয়। আমেরিকাতে যত সিইও দের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে-সবাই নাস্তিক। একজন সিইওর আসল দাম, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাতে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাকে যুক্তিবাদি হতে হবে। এই ভাবেই যুক্তিবাদি লোকেরা উন্নত বিশ্বের উৎপাদন কাঠামোতে শীর্ষস্থানে আছে এবং বাকিরাও যেহেতু সেই ক্লাবের মেম্বার হতে চাইবে -খুব স্বাভাবিক ভাবেই উন্নত বিশ্বে আস্তে আস্তে লোকেরা ধর্মের পা মারাতে চাইছে না । উইগনারের বর্তমান গবেষণা সেটারই দিকেই নির্দেশ দিচ্ছে।
[৩] এবার উইগনারের গবেষণাপত্রটি বোঝার চেষ্টা করি।
পাশের এই লেখচিত্রটিতে ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ভিয়েনা এবং নেদারল্যান্ড-এই চারটি দেশে গত ১৫০ বছরে ধর্মের প্রাবল্য কিভাবে কমেছে, তার লেখচিত্র আছে। তাদের মডেল এবং পরীক্ষামূলক তথ্য যেখানে মিলে যাচ্ছে। এবং এই দেশগুলিতে এখন ধর্মহীন লোকেরাই সংখ্যাগুরু। সুতরাং ধর্ম নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মহীন সত্যিকারের ধর্মনিরেপেক্ষ সমাজে বিবর্তনের জন্যে উইগনারের মডেলটি বোঝা দরকার।
উনি রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যারা ধর্মালম্বী বনাম যারা ধর্মহীন। ধরা যাক এরা দুটো ক্লাব-আমাদের মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের । বা ওর থেকে ভাল উদাহরন সিপিএম এবং তৃণমুল। ২০০৯ সালে তৃনমূল কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতা দখলের পর আমরা দেখেছি দলে দলে অনেকেই সিপিএম ক্লাব ছেড়ে তৃণমুল ক্লাবে যোগ দিয়েছে।
উইগনার ও বলছেন "লোকে ধর্মালম্বীদের ক্লাব ছেড়ে, ধর্মহীনদের ক্লাবে এবং উলটোটাও সব সময় হচ্ছে। এর কারন অনেক কিছুই হতে পারে- তার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা, নিজের মূল্যায়ন বাড়ানো ইত্যাদি কাজ করে। কোন ধর্মপ্রান হিন্দু বা মুসলিমকে কাজে নিতে যেকোন কোম্পানী দুবার ভাববে-কারন অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে এদের মধ্যে যুক্তিবাদি মন কম, বিশ্লেষন ক্ষমতা কম। ফলে চাকরী পাওয়ার জন্যেই একজন মুসলিম যেমন তার ইসলিময়ৎ কমাতে বাধ্য হবে-ঠিক তেমনি একজন হিন্দু তার হিন্দুয়ানী কমাবে। সেটা করেই তারা তাদের "সামাজিক মূল্য" বাড়াবে। এই সামাজিক মূল্য বাড়াবার তাগিদেই উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থায় আস্তে আস্তে জনগোষ্টি ধর্মহীন হওয়ার দিকে ঝুঁকবে।
আরেকটা উলটো উদাহরণ হাতের সামনেই আছে। জিয়উল হকের আগে পাকিস্থানে ইসলামের এত প্রাবল্য ছিল না । রাষ্ট্র থেকে ইসলাম পন্থীদের অনেক সুবিধা দেওয়া শুরু হল ১৯৭৮ সাল থেকে। সেকুলারিস্টদের খুন করা শুরু তখন থেকেই, যা বেনজির ভুট্টো থেকে পাঞ্জাবের গর্ভনর সালমন তসীরের মৃত্যুতে অব্যাহত। ফলে পাকিস্তানে অমুসলীম গোষ্ঠী আরো ছোট হচ্ছে এবং তার ফল কি হাতে নাতেই দেখা যাচ্ছে।
আবার এটাও আমরা দেখছি ভারতে ইসলামিস্ট এবং হিন্দুইস্ট বা ধর্মধারীরা বহাল হালেই থাকে। এর কারন ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও নেতারা ধর্মগুরু এবং ধার্মিক সম্প্রদায়ের নিকট সম্পূর্ন আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে বি এন পির আমলে রাষ্ট্রীয় মদতে ইসলামপন্থীদের অনেক সুবিধা দেওয়া হত-ফলে বাংলাদেশের ধর্ম নিরেপেক্ষ জনগোষ্টির জন্যে সেটা বাজে সময় ছিল। আবার এখন আওয়ামী লীগ যেহেতু বস্তুবাদি উন্নতির দিকে বা উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মহী গোষ্টি ভুক্ত হওয়া বাংলাদেশ আস্তে আস্তে "লাভজনক" হচ্ছে।
সুতরাং মোদ্দা কথা হচ্ছে উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থায় বুদ্ধিমান এবং যুক্তিবাদি লোকেদের বাজারদর "ধর্ম প্রাণ" লোকেদের চেয়ে বেশী। সুতরাং রাষ্ট্র এবং রাজনীতি যদি ধর্ম প্রাণ ব্যাক্তিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে-বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই ধর্ম আর আগামী শতাব্দির মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হবে। কারন বাজারদর বাড়াতে সবাই ধর্মহীন গোষ্ঠিতেই সামিল হবে।
অবশ্য ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক দর্শন বা আত্মদর্শন এক না । ধর্ম নিশ্চিহ্ন হলেও আধ্যাত্মিক দর্শনের কিছু চিন্তা থেকেই যাবে।
[ পাশের চিত্রটি উইগনারের পেপার থেকে নেওয়া। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৮০ টি গোষ্টীর মধ্যে ধর্ম থেকে ধর্মহীনতায় বিবর্তন এক মডেল অনুসরণ করে। ]
এই মুহূর্তে বিদেশি পুঁজির আবির্ভাব এতটাই আলোড়ন তুলেছে যে, এই প্রথম কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি নকল করে দেখালেন। এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী 'জাতির উদ্দেশে' ভাষণ দিতে গিয়ে জনগণকে প্রায় ধমকে বললেন, 'টাকা তো আর গাছে ফলে না!' আমরা সচকিত। রাজনৈতিক সচেতনতার তুঙ্গে বসবাসকালে গায়ে চিমটি কেটে নিজেদের জাগিয়ে রাখছি নিয়ত। নয়তো কোনও মহান দৃশ্য ফট করে মিস করে যেতে পারি।
আঞ্চলিক থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির এই যখন-তখন অবস্থানগত পরিবর্তন আমাদের বিস্মিত করে। যে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র শাসনকালে আস্ত একটা 'বিলগ্নিকরণ' মন্ত্রক ছিল এবং যে মন্ত্রক পূর্ববর্তী কংগ্রেস জমানার তুলনায় অধিকতর তীব্রতার সঙ্গে আর্থিক সংস্কার চালিয়েছিল, সেই বিজেপিই মনমোহিনীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে ভারত বন্ধ ডাকছে। তদানীন্তন এনডিএ জমানার অন্যতম শরিক তৃণমূল কংগ্রেস আর্থিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লাগাতার সোচ্চার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টিকায়েত বা হজারের স্টাইলে রাজধানীর রাজপথে নেমে পড়ছেন প্রতিবাদ করতে। জনপরিসরে আলোচনা চলছে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকৃত পরিচিতি সত্তা নিয়ে। এই দলটির তীব্র কোনও মতাদর্শগত ভিত্তি নেই। সামাজিক আত্তীকরণের মাধ্যমে এর ব্যাপ্তি, আত্তীকরণের কারণেই এর অস্থিরতা, সংখ্যালঘু দরদ, 'মতুয়া'ধর্মিতা কিংবা আর্থিক সংস্কার-বিরোধী স্লোগানমুখর বামপন্থা ইত্যাদি নানাবিধ পরিচিতিকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলা যথেষ্ট কঠিন কাজ।
আরও কঠিন, কারণ এগুলির জন্য যে সুদীর্ঘ ধারাবাহিক সামাজিক অভিনিবেশ প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। অর্থাৎ, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য সামাজিক বর্গগুলিকে সামনে নিয়ে আসা ও গুরুত্ব দেওয়া ওই রাজনৈতিক অবস্থানের মতোই অস্থিতিশীল। বামফ্রন্টকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য সংখ্যালঘু ও মতুয়া পরিচিতি সত্তা, আবার কেন্দ্রে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলার জন্য কিংবা রাজ্যে বামেদের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার জন্য আর্থিক সংস্কারের চরমপন্থী বিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে দলটির একটি আরোপিত সত্তাকে সামনে এনে দেয়। ভবিষ্যতে তৃতীয় ফ্রন্টের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস আসতেই পারে। কিন্তু তার জন্য যে সামাজিক সংযোগ দরকার, সেটা কোথায়?
অথচ কাল্পনিক সেই তৃতীয় ফ্রন্টের অন্যতম শরিক-দলের নেত্রী জয়ারাম জয়ললিতার সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও নেতৃত্বের ধরনে যতই সাদৃশ্য থাক, তা একান্তই বহিরঙ্গে। এ কথা ঠিক যে, মমতার মতোই জয়ললিতাও তাঁর দলকে প্রায় একক ইচ্ছানুসারে পরিচালনা করেন। তিনিও অতীতে কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তৃতীয় ফ্রন্টে নেতৃত্বের দাবিদার। কিন্তু তাঁর এই অবস্থান বদলের একটি ধারাবাহিকতা আছে, যা তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ডিএমকে-র অবস্থান-সাপেক্ষে স্থির হয়। পশ্চিমবঙ্গে যেমন রাজনৈতিক অবস্থান সামাজিক বর্গগুলির পারস্পরিকতার ভিত্তিকে স্থির করে দিচ্ছে, তেমনই তামিলনাড়ুতে প্রাথমিক স্তরে সামাজিক আন্দোলনের অভিঘাতে রাজনৈতিক ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে। পরে রাজনীতি সমাজনীতিকে গ্রাস করেছে।
এ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামাজিক অনুপ্রবেশের যে একটা প্রয়োজনীয়তা আছে, তা বিংশ শতকের প্রথমার্ধে তামিল রাজনীতিকদের একাংশ অনুভব করেছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক ভিত্তি নির্মাণের জন্য তাঁরা সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই কাজে প্রথমেই স্মরণীয় এরোড বেঙ্কট রামস্বামী নাইকার বা পেরিয়ার। জন্মসূত্রে কন্নড়ভাষী পেরিয়ার উপলব্ধি করেন যে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কী ভাবে কংগ্রেসের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি উচ্চবর্ণকে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করে এবং উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক ভাষাই হয়ে ওঠে প্রধান বক্তব্য।
১৯২৪ সালে গাঁধীজির ডাকে ভাইকম সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে পেরিয়ার বুঝতে পারেন যে, সামাজিক মুক্তি আন্দোলন ব্যতীত রাজনৈতিক বহিরঙ্গে পরিবর্তন আসবে না। সেই সূত্রে ১৯২৫-এ তিনি 'আত্ম-মর্যাদা'র আন্দোলন শুরু করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী এই প্রবল সামাজিক আন্দোলন তামিল জনমানসে এক তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী ওই সামাজিক আন্দোলনই জন্ম দেয় পৃথক রাজনৈতিক সত্তার। উচ্চবর্ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রথমে পেরিয়ারের দ্রাবিড় কাজাগাম এবং ১৯৪৯-এ পেরিয়ারের প্রধান শিষ্য আন্নাদুরাই-এর নেতৃত্বাধীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) জন্মলাভ করে। রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ ডিএমকে-র লক্ষ্য হলেও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত তামিল সমাজ বাস্তবতার পরিবর্তন। তাই দল গঠনের পরেই আন্নাদুরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাননি। ডিএমকে নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগদান করে ১৯৫৭-এ। ১৯৬৭-তে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়। আশ্চর্য, ১৯৬৯-এ আন্নাদুরাই-এর আকস্মিক মৃত্যুর পর ডিএমকে যে অন্তর্দলীয় নেতৃত্বের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল, তা-ই পরবর্তী কালে তামিল রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। দলের নেতৃত্বে উঠে এলেন করুণানিধি। শুধু ক্ষমতাদখলই নয়, তিনি দ্রাবিড় আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তিকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে ক্রমশ ডিএমকে'কে নিজের পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেললেন।
১৯৭২-এ তাই এম জি রামচন্দ্রনের নেতৃত্বে এআইএডিএমকে-র জন্ম স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মনে হয়। মজার বিষয় হল, যে ডিএমকে থেকে এই নতুন দলের সৃষ্টি, সেই উৎসই হয়ে উঠল প্রধান প্রতিপক্ষ, এমনকী শত্রু। উচ্চবর্ণবাদী কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানাল আন্নাদুরাই-এর নামাঙ্কিত নতুন দলটি। জরুরি অবস্থাও মেনে নিল। ১৯৭৭-এ ডিএমকে'কে পর্যুদস্ত করে ক্ষমতায় এল।
সেই থেকে ওই দুই দল তাদের সামাজিক ভিত্তি প্রায় বিস্মৃত হয়ে রাজনৈতিক সুবিধার্থে কখনও কংগ্রেস, কখনও বা বিজেপি-র হাত ধরেছে, অথচ পরস্পরের কাছাকাছি আসেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে এসে এআইএডিএমকে রামচন্দ্রনের উত্তরসূরি হিসেবে আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ-কন্যা জয়ললিতাকে নেতৃত্বে বরণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ, বর্ণহিন্দুদের প্রতি যে-বিদ্বেষ থেকে দ্রাবিড় আন্দোলন ও রাজনীতির সূত্রপাত, তার আজ কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। তামিল রাজনীতি বহিষ্কারের সামাজিক অবস্থানকে সংহত করে অন্তর্ভুক্তির রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে, পাল্টে গেছে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার এবং প্রতিপক্ষ।
পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগজনিত প্রবল সামাজিক যন্ত্রণাও সে ভাবে সাম্প্রদায়িক বা জাতপাত-ভিত্তিক রাজনীতির জন্ম দেয়নি। এর একটা বড় কারণ জাতীয় কংগ্রেসের সর্বজনীন মান্যতা এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রধানত কমিউনিস্টদের উপস্থিতি। কমিউনিস্ট রাজনীতি যাবতীয় সামাজিক বর্গগুলিকে শ্রেণিসত্তার গর্ভে বিলীন করে দিতে পেরেছিল। তৃণমূল কংগ্রেস সামাজিক বর্গগুলিকে আজ প্রধান করে তুলেছে। কিন্তু তা নতুন কোনও সামাজিক আন্দোলন ছাড়াই মূলত রাজনৈতিক দলীয় প্রেক্ষাপটে আবদ্ধ। এর ফলে ওই বর্গগুলির আচরণে ও দাবিদাওয়ার মধ্যে কোনও সুসংহত রূপ দেখা যাচ্ছে না। নেই কোনও বিশেষ রাজনৈতিক অগ্রাধিকারও। রাজনৈতিক অভিনিবেশ থাকবেই বা কী ভাবে? যে সি পি এম-বিরোধিতার তরণীতে ভাসমান রাজনীতি একটি প্রবাহ সৃষ্টি করেছিল, তা হঠাৎ দিক পাল্টে কমিউনিস্টদের স্লোগানগুলিকে আত্মসাৎ করতে চায়। আঞ্চলিক থেকে জাতীয় হয়ে ওঠার জন্য বদলে যায় প্রতিপক্ষ, কিন্তু সেই বিশেষ রাজনীতির কোনও ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠে না। শুধুমাত্র নির্বাচন-নির্ভর এক প্রকার সামাজিক সচলতা তৈরি হয় মাত্র।
দ্রাবিড় আন্দোলনের দুই সন্তান আজ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসর তাদের দখলে। দু'দলের নেতৃত্বের ধাঁচে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও তা বহিরঙ্গে। সামাজিক, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার স্থিতিশীল ঐতিহ্য নেই যে, উত্তরণ ঘটিয়ে নতুন অবস্থান নির্মিত হবে। তাই মনে হয়, সামাজিক বর্গ-নির্ভর বা বামপন্থী কোনও অবস্থানই স্থায়ী সামাজিক ভিত্তির জন্ম দেবে না।
আনন্দবাজার পত্রিকা
বাংলার জাতপাতের 'মিথ'
আমার প্রবন্ধ পড়ে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধায় তাঁর পত্রে (আ.বা.প ৯-১০) কয়েকটি মূল্যবান প্রশ্ন তুলেছেন। সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমত উনি উল্লেখ করেছেন যে, আমি আমার ২০০৪-এর একটি বইতে প্রকাশিত মত সাম্প্রতিক কালে পাল্টে নিয়েছি। আমার বই এত মনোযোগ দিয়ে কেউ পড়েন জেনে ভাল লাগল। এই প্রসঙ্গে বলি, আমার পূর্ব মত আমি অবশ্যই পাল্টেছি, খুব খোলাখুলি ভাবেই। এই পরিবর্তিত মত-সংবলিত দুটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই ছাপা হয়েছে। ২০০৪-এ মনে হয়েছিল, বহুজন সমাজ পার্টি বা সমাজবাদী পার্টি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা না-করে বেশি দূর এগোতে পারবে না। পুরোনো ইতিহাসের ধারা তাই বলে। গত আট বছরে বসপা এবং সপা যে ভাবে জনসংগঠন বাড়িয়েছে, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা খানিকটা অভাবনীয়। অতীতের শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন বা রিপাবলিকান পার্টির জনসংগঠনের ধারা থেকে এই সংগঠন সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা। তাদেরও সমঝোতা করতে হয়েছে। তবে উল্টোটাও ঘটেছে অর্থাৎ মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিকেও তাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার আবশ্যিকতা আগে ছিল না, এখন হয়েছে। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় বক্তব্যটি আরও জরুরি এবং বিশদ মন্তব্যের দাবি রাখে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত সমস্যা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। ২০০৪-এর বইতে এবং তারও আগে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত নমঃশূদ্রদের ইতিহাসে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, ১৯৪৬-'৪৭-এর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং দাঙ্গার চাপে দলিতগোষ্ঠীগুলির প্রতিবাদী আন্দোলন হারিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা মূলস্রোতে মিশেও যাচ্ছে বা। কিন্তু আমি এ-ও উল্লেখ করেছিলাম, তাতে বাঙালি সমাজে জাতপাতের সমস্যার সমাধান হয়নি মোটেই। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর এই দলিত প্রতিবাদী আন্দোলন কেন দুর্বল হয়ে গেল, এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর তখনও আমি পাইনি। কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা না-করলে সে উত্তরটা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার সাম্প্রতিক গবেষণা এই সময়ের উপর। এবং তার প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলি আমার পুরোনো মত খানিকটা পাল্টাতে বাধ্য করেছে বইকী। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আমার নমঃশূদ্র ইতিহাসের বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বার করেছে। তাতেই আমার পরিবর্তিত মত প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার বিশদ পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। সংক্ষেপে দু'চার কথা বলতে পারি। পশ্চিমবঙ্গের দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী আন্দোলন যে স্বাধীনতার পরে হারিয়ে যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ হল, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা এবং আন্দোলন। বাংলার উদ্বাস্তুদের এক বিরাট অংশ বিশেষ করে যাঁরা ১৯৫০-এর পর এ-পারে এলেন, ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের লোক। এই জরুরি তথ্যটা উদ্বাস্তু ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই 'উদ্বাস্তু' এই নতুন আত্মপরিচয় লাভ করেন। দলিত আত্মপরিচয়টা আড়ালে চলে যায়। দেশভাগের আগে যে দলিত নেতারা জাতপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফলে, দলিত আন্দোলন সাময়িক ভাবে পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু জাতপাতের সমস্যা যে তাতে আদৌ কমল না, সেটা টের পাওয়া গেল ২০০৪ সালের শেষের দিকে। যখন প্রাথমিক স্কুলগুলিতে বাচ্চাদের মধ্যাহ্নভোজ খাওয়া নিয়ে বির্তক বাধল। দলিত স্বেচ্ছাসেবীদের হাতের রান্না ব্রাহ্মণের ঘরের ছেলেরা মুখে তুলবে না, অনেক উদারপন্থী বা বামপন্থী বাঙালি সে সম্ভাবনাটা কখনও ভেবে দেখেননি। আসলে সমস্যাটা রয়েই গেছে। আমরা একটা 'মিথ' নিয়ে বাস করি যে, বাংলায় জাতপাত নেই। এটাকে মনে করি আমাদের বাঙালিয়ানার একটা প্রতীক। যেখানে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের চেয়ে আমরা আলাদা। তাই এই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও বেশি হয়নি। তবে এই বিষয়ে ইদানীং যে ক'টি গবেষণাপত্র আমার চোখে পড়েছে, তার থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে আসে। তা হল, ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েতি রাজ সত্ত্বেও জাতপাতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের যে সম্পর্ক ঔপনিবেশিক বা তার আগের যুগে ছিল, তার মূলগত পরিবর্তন খুব একটা ঘটেনি। তাই মতুয়া মহাসঙ্ঘের জনপ্রিয়তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। খাস কলকাতায় বসপা-র জনসভার ভিড় অনেক উদারপন্থী/বামপন্থী বাঙালিকে অস্বস্তিতে ফেলে। মতুয়াদের সমর্থন পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বলে দেয়, অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পার্থক্যটা এমন কিছু বিরাট নয়। তবে পার্থক্য অবশ্যই কিছুটা আছে। জাতপাতভিত্তিক হিংসাশ্রয়ী ঘটনা এখানে বিরল। তার অবশ্য কিছু ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্বল্প পরিসরে তার আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি একমত যে, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আমার নিজের গবেষণা এখনও মাঝপথে। তার আগে প্রত্যয় নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দিতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আরেকটি কথা। বর্তমানের উপর দাঁড়িয়েই ঐতিহাসিক অতীতের দিকে তাকান। পরিবর্তনশীল বর্তমান নতুন নতুন প্রশ্ন তুলে ধরে। আর ঐতিহাসিক সেই প্রশ্নগুলিকে অতীতের দিকে নিক্ষেপ করেন। তার উত্তর খোঁজেন। এ ভাবেই যুগে যুগে ইতিহাসের ব্যাখ্যা পাল্টায়। আশা করি, আমাদের এই নতুন বাস্তবতা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবাবে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটন, নিউজিল্যান্ড
হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী
রেটিং :
0.62%
গড় রেটিং:
রবীন্দ্রনাথ অধিকারী
আজ মঙ্গলবার পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২০০তম জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছরের মতো এবারও তার লীলাভূমি কাশিয়ানীর শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে অনুষ্ঠিত হবে স্নান উৎসব ও মহাবারুণীর মেলা। হবে লাখ লাখ মতুয়া ভক্তের সমাবেশ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা_ ব্রিটিশ শাসনের সূর্য তখন মধ্যগগনে। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণ বিভেদ, জাতপাত ও ধর্মের হানাহানির কারণে এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে এ ভূখণ্ডের ধর্ম সংস্কৃতির তখন দুরবস্থা। মানবিকতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধ তখন ভূলুণ্ঠিত। উচ্চবর্গীয়দের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনে নিম্নবর্গীয় ব্রাত্যজনরা নিদারুণ নিষ্পেষিত। যুগের এ তমসাচ্ছন্ন সময়ে ধর্মের গ্গ্নানিকালে যুগবতার রূপে আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হলেন পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বিভেদবাদী ধর্ম-বর্ণের সমন্বয়ক এবং ঐক্যের প্রতীক, অহিংসা ও মানবতাবাদী। পূর্ণাঙ্গ প্রেমময় সত্তা ও পরম পুরুষ। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সাফলীডাঙ্গা গ্রামে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রাম ছিল তার লীলাভূমি ও সাধনক্ষেত্র। এ ওড়াকান্দিতে তিনি ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। এ শ্রীধাম ওড়াকান্দি এখন একটি হিন্দুদের অন্যতম তীর্থ কেন্দ্র। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের বাবার নাম যশোবন্ত ঠাকুর, মায়ের নাম অন্নপূর্ণা দেবী। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতৃকুল ব্রাহ্মণ এবং মাতৃকুল নমঃশূদ্র। তিনি আজীবন মানুষের সেবা করেছেন। ধর্ম ও সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন লোকনায়ক এবং লোকগুরু। তার সহজ সাধন পথের নাম মতুয়াবাদ। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বলা হয় 'মতুয়া'। মতুয়া শব্দের অর্থ হলো মাতোয়ারা বা মেতে থাকা। যারা এ নামে মাতোয়ারা বা অনুরাগী তারা মতুয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, যারা তার মতের অনুসারী তারাই মতুয়া। বিশ্বে হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মাতুয়াবাদে বিশ্বাসীরা মতুয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিত। হরিনাম সংকীর্তন হচ্ছে তাদের ভজনের পথ। তারা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরকে বিষ্ণুর অবতার বলে জ্ঞান করে। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বিভিন্ন ধর্মের লোককে তার ধারায় একত্র করেছিলেন। তার ভাবাদর্শের অনুসারী হয়েছিলেন খ্রিস্টীয় ধর্মীয় যাজক ডা. সিএস মিড। তিনি খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকের কাজ করতে এসে ঠাকুরের আদর্শে উজ্জীবিত হন। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ অক্ষয় চক্রবর্তী ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের অন্যতম অনুসারী। বৈশ্য সম্প্রদায়ের মালঞ্চ সাহা ছিলেন তার বিশিষ্ট ভক্ত। মুসলিম ধর্মাবলম্বী তিনকড়ি মিয়া ছিলেন তার অনুগামী। নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের হীরামন, দশরথ, মৃত্যুঞ্জয়, লোচন, গোলক ছিলেন তার পার্ষদ। এভাবেই তিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন সেতু তৈরি করে মানবতার ধারায় একই সূত্রে সম্মিলিত করেছিলেন। আলোকিত সমাজ গড়েছিলেন। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিশ্বে তার প্রায় ২ কোটি অনুসারী রয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মার দক্ষিণ পাড়ের অংশে তার প্রভাব খুবই প্রবল। এ অঞ্চলে রয়েছে তার অসংখ্য ভক্ত ও মন্দির। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন ও আদর্শের বাণী নিয়ে কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেছেন 'শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্থ'। হরিভক্তদের কাছে যা অনবদ্য শাস্ত্র হিসেবে নিত্যপাঠ্য। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন অবহেলিত, বঞ্চিত ও হতভাগ্য শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং সমাজ চিন্তাবিদ ও লোকগুরু। তার মতুয়া আন্দোলন এ অঞ্চলের কৃষকদের অধিকার আদায়ে, শোষণ, বঞ্চনা, ঘৃণার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে এবং আপসহীন সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে। পতিত জমি উদ্ধার ও আবাদ করার কাজে কৃষকরা যাতে উদ্যোগী হন সে জন্য নিজেই লাঙল নিয়ে পতিত জমি কর্ষণ করে তিনি আবাদের আন্দোলন করেছিলেন। নীল কুঠিয়াল ডিক সাহেবের বিরুদ্ধে জোনাশুর কুঠি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গের সব নিষ্পেষিত ও অবহেলিত মানুষকে হরিনামের একতামন্ত্রে উদ্বোধিত করে গেছেন। তার ধর্মীয় আদর্শ ও মানবতার মাহাত্ম্যে তার লীলাভূমি ওড়াকান্দি মহাপবিত্র ধাম হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী স্নান উৎসব হয় এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে দলে দলে ভক্তরা এ স্নান উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। লাখ লাখ ভক্তের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে শ্রীধাম ওড়াকান্দির হরি মন্দির ও মেলাঙ্গন। ঠাকুরের শুভ জন্মতিথির মহতীলগ্নে তার ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। যেন তার কৃপায় পাপমোচন হয়, আত্মশুদ্ধি হয়, ঘটে আত্মোন্নতি। যেন তার প্রদর্শিত আলোক ছটায় হৃদয় অন্দরকে আলোকিত করে_ ভক্তরা সেই প্রার্থনা করেন। তিনি যেন অজ্ঞতার হৃদয়রাজ্যে ও কূপমণ্ডূকতায় জ্ঞানের আলো, জীবনের দীপ ও ভক্তির নবারুণ জ্বেলে দেন, ভক্তরা সে কামনাই করেন।
মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক
মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ পুনঃসংশোধন এবং পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে ভারতে চলে আসা সমস্ত মানুষের নাগরিকত্বের দাবিতে গণকনভেনশন অনুষ্ঠিত হল আজ বুধবার কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে। দেশভাগ করেছিল জাতীয় নেতৃত্ব। তাতে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। তাই ওই নেতারা দেশান্তরী মানুষের নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কিন্তু অন্য কথা বলছে। তাই ওই আইন পুনঃসংশোধনের দাবিতে মতুয়া মহাসংঘ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। আজ তারা সেই দাবি আদায় থেকে পিছু হটছে। তাই আজ সাধারণ মতুয়া জনগণ, গণতান্ত্রিক মানুষ, বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, পত্রিকা গোষ্ঠী ফের একত্রিত হয়ে এই কালাকানুনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। কংগ্রেস, সিপিএম ও বামফ্রন্টের দলগুলির নেতারা প্রকাশ্য সমাবেশে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তুদের পক্ষে আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। তবু কাজ আর এগোয়নি। রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রতি মতুয়াদের আশা ছিল। তাদের নেতা তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকারে মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু তিনি এখন এবিষয়ে নীরব। সরকারও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে। তাই আজ এই আন্দোলনের পুনঃপ্রস্তুতি।
প্রাই আড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় সমাজে সামাজিক পদমর্যাদার বহুবিধ ধাপ দেখতে পাই। ধাপগুলি পিরামিডের আকারে সাজানো। সর্বোচ্চ ধাপে ব্রাহ্মণ এবং সর্বনিম্ন ধাপে অস্পৃশ্য জাতিগুলো এবং জাতি-ব্যবস্থায় না-ঢোকা আদিবাসীরা। খ্রিস্টধর্মর্ে ও ইসলামে জাতিব্যবস্থার কোনও স্থান নেই, কিন্তু তারাও ভারতে জাতি-কাঠামো অনুযায়ী বিভক্ত হয়ে পড়ে।
সামাজিক শ্রম-বিভাজনে কোন ব্যক্তি কী ভাবে অংশগ্রহণ করবেন এবং ফলে, সামাজিক উৎপন্নের কতটুকু অংশ ভোগ করবেন তা মূলত তিনি কোন ধাপে জন্ম নিয়েছেন সেটা দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক উৎপাদকদের অবস্থান পিরামিডের সর্বনিম্ন ধাপে। একটি রাজনৈতিক সূত্রীকরণের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষদের সম্পত্তির অধিকার ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। তেমনই একটি ধর্মীয় মতাদর্শগত সূত্রীকরণের মাধ্যমে দ্বিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির কোনও সচলতা থাকে না।
সমবেত। সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভা। কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১০
এই পরিস্থিতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে সমাজের উৎপাদক শ্রেণিগুলো সামাজিক উৎপন্নের বণ্টনে নিজেদের অংশ বৃদ্ধি করার জন্য সংগ্রাম করবে এবং এই সংগ্রাম সর্বদা সরাসরি শ্রেণি-সংঘাতের পথে না গিয়ে কখনও কখনও ধর্মীয় মতাদর্শগত সংগ্রামের রূপ নেবে। চার্বাক ও বুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবির, নানক ও শ্রীচৈতন্য হয়ে আধুনিক কালের জ্যোতিবা ফুলে, অম্বেডকর, শ্রীনিবাস গুরু ও পেরিয়ার পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এই সাধারণ ধারা অনুসরণ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর ধাপগুলির মধ্যে কিছু পরিমাণে অভ্যন্তরীণ শ্রেণি-বিভাজন ঘটেছে যা চলমান সংগ্রামকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে।
অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে এই ধারারই সংগ্রাম ছিল মতুয়া আন্দোলন। ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দির বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮)-এর নেতৃত্বে এক বিরাট সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। হরিচাঁদ 'হাতে কাম, মুখে নাম' এই বাণীর মাধ্যমে বলেন যে, নমঃশূদ্ররা কারও চেয়ে হীন বা নিচু নয়। কাজ করা বড় ধর্ম, শ্রমে অংশ নাও এবং গার্হস্থ্য জীবনে থাকো। কারও কাছে দীক্ষা নিও না বা তীর্থস্থানে যেও না। ঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। দলে দলে মানুষ হরিচাঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং যাঁরা তাঁর 'মত' গ্রহণ করেন তাঁরাই মতুয়া নামে পরিচিত হন।
হরিলাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭) মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ১৯১১ সালের লোকগণনায় 'চণ্ডাল' নামের বদলে 'নমঃশূদ্র' নাম ব্যবহৃত হয়। নমঃশূদ্র ছাড়াও আরও অনেক নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন, কাপালি, পৌণ্ড্র, গোয়ালা, মালো, ও মুচি মতুয়া আন্দোলনে যোগ দেন।
তাঁর পিতার নির্দেশের সঙ্গে গুরুচাঁদ যুক্ত করেন শিক্ষা বিস্তারের এবং জমিদার-বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি। এ ছাড়াও তিনি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণস্বাস্থ্যের উপর খুব নজর দেন। কোনও গ্রামের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য এলে তিনি তাদের কাছে এই শর্ত রাখতেন যে গ্রামে প্রথমে একটি স্কুল স্থাপন করতে হবে এবং মাঠে-ঘাটে মলত্যাগ না-করে বাড়িতে পায়খানা বানাতে হবে। অষ্ট্রেলীয় মিশনারি মিড সাহেবের সহায়তায় তিনি বহু স্কুল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে যে মানুষেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁর বাণী ছিল, "তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই বিদ্বান হইতে হবে পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ চিরসুখী হবে ভবে।" তাঁর সময়ে কিছু স্কুল থাকলেও তাতে অস্পৃশ্য শিশুদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তো ব্রাহ্মণ (পুরুষ) ছাড়া আর কারও ভর্তি হওয়ার অধিকার ছিল না। ১৮৮০ সালে ওড়াকান্দি গ্রামে স্কুল স্থাপিত হয়। এটি ছিল নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য নিম্নবর্ণ মানুষদের দ্বারা স্থাপিত প্রথম স্কুল।
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া মতুয়ারা ছিলেন প্রধানত ভূমিহীন কৃষক। জমিদার ও মহাজনদের শোষণে জর্জরিত। তাই তাঁদের মধ্যে জমি সংক্রান্ত দাবি উঠে আসতে থাকে। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে নমঃশূদ্র নেতা ভীষ্মদেব দাস এবং নীরদবিহারী মল্লিক তেভাগার দাবি উত্থাপন করেন। এঁরা দু'জনেই ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। ১৯৩৩ সালে ঘাটালে সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলনে গুরুচাঁদ নিজে যোগ দেন। এবং জমিদারি উচ্ছেদ ও তেভাগার দাবি রাখেন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিধানসভার ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৬টি আসন জেতে। বাকিগুলি নির্দলীয় প্রার্থীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতেন। ৩০ জনের মধ্যে ১২ জন ছিলেন নমঃশূদ্র, যাঁদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কংগ্রেসের, বাকি ১০ জন ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। বিধানসভায় রায়তদের অধিকার সংক্রান্ত বিল পাশ করানোয় এঁদের ভূমিকা ছিল। গুরুচাঁদের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে মতুয়া আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে বেশির ভাগ সংরক্ষিত আসন কংগ্রেস জিতে নেয়। তা সত্ত্বেও নমঃশূদ্র নেতা যোগেন মণ্ডলের উদ্যোগে বি আর অম্বেডকর বাংলা থেকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত হন।
দেশভাগের পর এবং বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বহু নিম্নবর্ণের মানুষ উদ্বাস্তু হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেন। তবে এখনও এঁদের বেশ বড় একটা অংশ বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অনুযায়ী তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে কমে। ২০০৩ সালে এন ডি এ পরিচালিত সরকার যে নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে তাতে উদ্বাস্তুদের বিশেষত ১৯৭১ সাল বা তার পরে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে পড়েছে। ৩০-৪০ বছর ধরে এ দেশে বসবাস করছেন এমন মানুষকেও 'বাংলাদেশি' বলে তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আর এক বার উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা তাদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। সেই অবস্থায় তাঁরা সর্বজনীন ভোটাধিকারকে ব্যবহার করে একটা রক্ষাকবচ আদায় করতে চাইছেন।
এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান। উদ্বাস্তুদের বড় অংশ বামপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বামপন্থীরা তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দেননি। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ বাংলার নিম্নবর্ণের মধ্যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, এই ভূমিকা এখনও স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর বামপন্থীরা বিলম্বিত হলেও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তৃণমূল এবং বি জে পি যারা ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়েছেন তারাও মতুয়াদের মঞ্চে হাজির। তাঁরা নাকি মতুয়াদের দাবি সমর্থন করেন। অথচ মতুয়াদের প্রধান দাবি ছিল নাগরিকত্ব আইন (২০০৩)-এর সংশোধন। রাজ্যের আবাসন দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব প্রস্তাব করলেন যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদ এক সঙ্গে দিল্লি গিয়ে মতুয়াদের দাবি পেশ করবেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কাজটা তো সেই ২০০৩ সালেই করা যেত, যখন ৪২ জন সদস্যের মধ্যে ৩৬ জনই বামফ্রন্টের ছিলেন।
ভারতে সমাজে আধুনিকতার শর্ত হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রসার। যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাতি-বর্ণ ও অন্যান্য পরিচিতি ভিত্তিক শ্রম বিভাজনের বিলোপ। শুধু আইনের বইতে নয়, বাস্তব জীবনে। এই দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য্যগুলোর সাফল্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গ এখনও অনেক পিছনে। কোনও কোনও ব্যাপারে বিহারেরও পিছনে। মতুয়া আন্দোলনের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে অবদমিত পরিচিতিগুলো সম অধিকার ও মর্যাদার জন্য সংগ্রামকে রাজনৈতিক মঞ্চে তুলে আনতে পারবেন কি না, ইতিহাসই বলবে। কিন্তু সন্দেহ নেই, পশ্চিমাঞ্চলে লাল মাটির দেশ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত আত্মপ্রতিষ্ঠার আওয়াজ মানুষকে আলোড়িত করেছে।
মতুয়া আন্দোলন যদি নাগরিকত্ব প্রশ্নে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা সমাজের গণতন্ত্রীকরণের লক্ষ্যে অন্যান্য অবদমিত জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, তা হলে তা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারবে।
মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হলেন যুগাবতার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর । তিনি বাংলা ১২১৮ সালের ২৯ শে ফাল্গুন , ১৮১২ ইংরেজী সালের ১১ই মাচ' বুধবার মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে ব্রহ্মমুহূর্তে এই পৃথিবীতে অবর্তীন হন । এই সময়টা ছিল বারূনী স্নানের পূন্য লগ্ন । তিনি ১২৮৪ সালের ২৩শে ফাল্গুন , ইংরেজী ১৮৭৮ সালের ৫ই মাচ' বুধবার একই তিথিতে মানবলীলা সংবরন করেন । একই তিথি , বারে ও লগ্নে জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনা বিরল ।
বংশ পরিচয় :-
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতার নাম ছিল যশোবন্ত ঠাকুর এবং মাতার নাম অন্নপূর্না দেবী । উভয়েই ছিলেন পরম বৈষ্ণব । যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ পুত্র । ঠাকুর হরিচাঁদ ছিলেন দ্বিতীয় । অন্যান্যরা হলেন কৃষ্ণদাস , বৈষ্ণবদাস , গৌরীদাস এবং স্বরূপদাস । ঠাকুর হরিচাঁদের পূব্ব্ পুরুষ রামদাস ঠাকুর ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মন ও পরম বৈষ্ণব । তিনি তীর্থ পরযটন করতে করতে বাংলাদেশে আসেন । তার অধঃস্তন পুরুষ সবাই ছিলেন ঈশ্বর পরায়ন । এই পবিত্র বংশেই অবতার রূপে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্ম গ্রহন করেন ।
আবির্ভাবের পটভূমি :-
স্রষ্ঠার সৃষ্ঠির সব কিছুই একটি সু-শৃঙ্খল নিয়মাধীনে চলছে । কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখাদিলে প্রাকৃতিক শক্তি সেখানে শৃঙ্খলা বা সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন । এই সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মাঝে মাঝে এই ধরার বুকে অবতাররূপে ভগবনের আবির্ভাব ঘটে । আর এই কারেনই শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের শুভাগমন হয়েছিল ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পৃথিবীতে কি রাষ্ট্রীয় জীবন , কি সমাজ জীবন সকল ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল । কিছু সংখ্যক সুযোগ সন্ধানী মানুষ সাধারন মানুষের সততা ও সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধর্মের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে ।ধম্ম হয় শোষনের হাতিয়ার ।ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়ে ধম্মকে সীমিত গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে । ধর্মের আবরনে এক শ্রেনীর ভন্ডের দল অনাচার ও ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় । ধর্মে দেখা দেয় গ্লানি । মানুষ ধম্মহীন হয়ে এক প্রানহীন সত্বায় পরিনত হয় ।ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পরযন্ত ব্রাহ্মন্যবাদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে । এর ফলে সাধারন মানুষ তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় । ধীরে ধীরে সৃষ্ঠি হয় অমানবিক জাতিভেদ প্রথা । সাধারন মানুষদেরকে তাদের ধম্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় । তাদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয় । এমনকি হিন্দু ধম্মের প্রধান ধম্মগ্রন্হ বেদ পাঠ , এমনকি শ্রবন নিষিদ্ধ করাহয় ।
এ সময় তৎকালীন রাষ্ট্র-নায়কদের ছত্রছায়ায় ব্রাহ্মন্যবাদীরা এদেশের আদি অধিবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে । ফলাফল স্বরূপ অনেকেই দলেদলে ধম্মান্তরীত হতে শুরু করে । অনেকেরই ধন-সমপত্তি কেড়ে নেওয়া হয় । সমাজ ব্যবস্হায় চরম ভেদ-বৈষম্য হওয়ায় একদল মানুষকে হীন পতিত ও অবহেলিত করে রাখা হয় । ছুৎমার্গের বিষবাষ্পে সমাজ জীবনে নেমে আসে অশান্তির কালো ছায়া । এই ছুৎমার্গীদের নিশ্পেষনে অতিষ্ট হয়ে দলে দলে অবহেলিত , নির্যাতিত লোক ধম্মান্তরীত হতে থাকে । এসময় সমাজ জীবনে গুরুবাদ ও গুরুমন্ত্রের খুব প্রভাব বিস্তার করে । প্রেমহীন গুরুর দেওয়া প্রানহীন মন্ত্রসাধনাই চুড়ান্ত ধম্মীয়-সাধনা বলে বিশ্বাস করতে জনসাধারন অভ্যস্হ হয়ে পড়ে । ফলে নিষ্ঠা-প্রেম-পবিত্রতা প্রভৃতি সদগূনের অনুশীলন অবশ্য করনীয় বলে বিবেচিত হতোনা । সমাজের এই অসহায় মানুষদের এই চরম অন্ধকরাছন্ন দিনে , মনুষ্যত্বের চরম লাঞ্চনায় মানবাত্মা নিঃস্ব-নিপীড়িত , অত্যাচারিত মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে এবং ধম্মকে রক্ষার জন্য পূনব্রহ্ম অবতারের আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী যাদের মানুষ বলে গন্য করা হয়নি , যাদের চন্ডাল বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল , তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কেউ এগিয়ে আসেনি । ব্রাহ্মন্যবাদী বৈষ্ণবধর্মের কাছে যারা ছিল পশুবৎ , সেই অশ্পৃশ্য-চন্ডাল জাতির উদ্ধারের জন্য পরম প্রেমময় , পরম দয়াল , অকুল পাথারের কান্ডারী যুগাবতার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর । কবি রসোরাজ তারক চন্দ্র সরকার লিখিত শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্হে হরি অবতারের সুন্দর বর্ননা দেয়া আছে --
উক্ত গ্রন্হদ্বয়ের কথানুসারে মহাপ্রভূর দুই জন্মের এক জন্ম খেতরে শ্রীনীবাস রূপে । তাহলে দ্বিতীয় জন্ম কোথায় ? গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর জন্ম নদীয়ায় হলেও লীলা সাঙ্গ করেন ওড়িষ্যা পূরীতে । সেখান থেকে ওড়াকান্দি ঈশান কোনে অবস্থিত । তাই বলা যায় তিনি পুনরায় ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ রূপে এসে কলির জীবদেরকে হরিনাম দান করে সেই প্রতিজ্ঞা পুরন করেছেন ।
শ্রীচৈতন্য ভাগবতের মধ্যম খণ্ডের ২৬ অধ্যায়ে দেখা যায় , গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস গ্রহনের ইচ্ছা শুনে তাঁর ভক্তগন তাঁর বিরহে ব্যাকুল হলে তিনি তাদের প্রবোধ দেন এই বলে --
সকল কালে তোমরা সকলি মোর সঙ্গ
এই জন্ম হেন না জানিবা জন্ম জন্ম ।।
এইমত আরো আছে দুই অবতার
কীত্তন আনন্দরুপ হইবে আমার ।।
তাছারা শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্হে কবিরসরাজ তারক চন্দ্র সরকার আরো একটি প্রমান দিয়েছেন । মহাপ্রভু যখন দারূব্রহ্মের সঙ্গে মিশে গিয়ে লীলা সাঙ্গ করেন তখন ভক্তগন কাতর হয়ে উক্ত বিগ্রহের উপর চড়াও হন ।তখন শূন্যবানী হয়--
মানুষে আসিয়া , মানুষে মিশিয়া
করিব মানুষ লীলে ।
সেইত সময় , পাইবে আমায়
পুনশ্চ মানুষ হলে ।।
উপরোক্ত প্রমান সাপেক্ষে আমরা বলতে পারি অন্যান্য সব অবতারের শেষ অবতার এবং গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুই যে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ রূপে শ্রীধাম ওড়কান্দি এসে জন্ম গ্রহন করছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর পূর্নাবতার :-
শ্রীশ্রী হরিলীলমৃত গ্রন্হে কবি রসরাজ তারক চন্দ্র সরকার লিখেছেন --
রাম হরি কৃষ্ণ হরি শ্রী গৌরাঙ্গ হরি ,
হরিচাদ আসল হরি পূর্নানন্দ হরি ।।
যুগে যুগে আবিরভুত সব অবতার মাত্রই শক্তির প্রতীক ।প্রত্যেকেই অসীম শক্তির আধার । তাদের সাথে সাধারন মানুষের যথেষ্ঠ পার্থক্য , কোন তুলনাই চলেনা । তাদের কৃত কম্মও অসাধারন , অলৌকীক, অতুলনীয় । সব্বগুনযুক্ত সকল শক্তির আধার স্বরূপ ভগবান অবতাররূপে তথা মানুষরূপে ধরাধামে আসেন । সাধারন মানষের সঙ্গে তাদের পার্থক্য , তাঁরা অন্তর্যামী , দুরদ্রষ্টা , ভবিষ্যত বক্তা । অবতারের শক্তি অপ্রতিহত ভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সকলেই তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয় । এসব গুন সাধারন মানুষের মধ্যে দেখাযায় না । আমাদের ধম্মীয় শাস্ত্র গ্রন্হাদিতে প্রমানিত হয় পুর্বেরকার কোন অবতারই পূর্নাবতার নন । ভগবান রাম , কৃষ্ণ প্রভৃতি অবতারের কৃত কম্মও পক্ষপাত মুক্ত নয় । তাছাড়া এই অবতারগন সকলেই কোন না কোন গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন , সাধনা করেছেন , দেব দেবীর পূজা করে তাকে সন্তুষ্ট করে আপন অভীষ্ট পুরন করেছেন । বিনা সাধনায় তারা কিছুই করতে পারেননি । কিন্তু হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলা সবকিছুই অন্যান্য অবতার থেকে স্বতন্ত্র্য । তাকে কারো কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হয়নি , সাধন-ভজন করতে হয়নি , মন্ত্র-তন্ত্রও জপ করতে হয়নি । তার জীবনে যা কিছু ঘঠেছে সব কিছুই বৈচিত্রময় , অলৌকীক । ঠাকুরের নিজ মুখের বানী--
অংশ অবতার যত পূব্বেতে আইলো,
আমি পূন জানি তারা সকলি জুটিল ।।
রাম,কৃষ্ণ,বৌদ্ধ আদি অথবা গৌরাঙ্গ ,
আমাকে সাধনা করে পেতে মম সঙ্গ ।।
পূ্ন আমি সব্বময় অপুর্নের পিতা ,
সাধনা আমার কন্যা আমি জন্মদাতা ।।
আমি হরিচাঁদ এবে পূর্নের অবতার ,
অজর অমর আমি ক্ষীরোদ ঈশ্বর ।।
উপরোক্ত বানীর তাতপর্য বিশ্লেষন করলে ষ্পষট প্রতিয়মান হয় যে , হরিচাঁদ ঠাকুর ছাড়া এ পর্যন্ত যে সমস্ত অবতার হয়েছেন তারা সবাই ঈশ্বরের অংশ মাত্র , কেউই পুর্নাবতার নন । গুরুচাঁদ চরিতে' বলা হয়েছে --
যারা অবতার হলো সকলি অপুর্ন ,
পুনর্শক্তি বিনা কভু কলি নহে জীর্ন ।।
এজন্যই পুর্নব্রহ্ম হরিচাঁদ পুর্ন শক্তি নিয়ে ধরায় অবতীর্ন হয়েছিলেন । তিনি ধরায় এলে অন্যান্য যুগের ভক্তগন এসে জন্মগ্রহন করেন--
স্বয়ং এর অবতার হয় যেই কালে,
আর আর অবতার তাতে এসে মিলে ।। শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ।
এর প্রমান মিলে শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতে বর্নীত বিভিন্ন উপাখ্যানগুলিতে । হীরমনের রাম-রূপ দর্শন, ঠাকুর হরিচাঁদের সহিত গোস্বামী লোচনের মিলন, গোস্বামী গোলকচাঁদের চতুর্ভূজ রুপ দর্শন, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের উপাখ্যান, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পদে রামচাদের পদ্ম দর্শন, কলমদাস বৈরাগীকে কৃষ্ণ রুপ দেখানো ইত্যাদি আরো অসংখ্য ঘটনা ঠাকুরের পুর্নতার বহিঃপ্রকাশ । শ্রীশ্রী ঠাকুরের বাল্য ও কৈশোরের উপাখ্যান গুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ঐশী শক্তির প্রকাশ :-
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ওড়াকান্দি গ্রামে । তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টা বিস্ময়কর ও অলৌকিক কর্মকান্ডে বৈচিত্রময় । ভুমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই তিনি তিন বার --আমি হরি,আমি হরি, আমি হরি-- বলে নিজের পরিচয় দান করেছিলেন । তার মুখের এই অনন্য-অসাধারন বানী শুনেও সাধারন মানুষ তাকে চিনতে পারেনি । কৈশোরে তাঁর বাল্যসখা বিশ্বনাথ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার প্রান দান করে ঠাকুর হরিচাঁদ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই নিদানের কর্তা হরি । এই ঘটনার পরপরই ঠাকুর হরিচাঁদ আরো এক অলৌকিক লীলা প্রকাশ করলেন । সফলাডাঙ্গায় অবস্হিত এক -বার-এর শক্তিকে আকর্ষন করলে -বার- শক্তিহীন হয়ে পড়ে । শ্রীশ্রীহরীলীলামৃতে আছে--
--ঠাকুরের জ্যোতি হরিচাঁদেতে মিশিল,
ব্রজনাথে লয়ে হরি নিজালয়ে গেল ।।
যে মানুষ মম দেহে আবির্ভুত ছিল ,
ঐ যে সে মানুষ মানুষে মিশে গেল ।।
এই সব দেখে সাধারন মানুষ বুঝলো, যশোবন্ত নন্দণ হরি ব্রহ্মপরাতপর । ঠাকুর হরিচাঁদ তাঁর বল্য সখাদের নিয়ে মাঠে গরু চড়াতেন । গরু রাখতে গিয়ে তিনি রাখালিয়া খেলার ছলে ব্রজলীলারভাব ও কার্যকলাপ করিতেন । বিষধর সাপ ধরে খেলানো, আবা ধ্বনি দিয়ে গরুদের ডাকা মাত্র ছুটে আসা, দাদা কৃষ্ণদাসের মৃত গরুর জীবন দান প্রভৃতি লীলা দেখে সাধারন মানুষ বলতো, হরিচাঁদ অলৌকিক ও ঐশী শক্তির অধিকারী । পরবর্তীকালেও তিনি অনেক অলৌকিক লীলা করেছেন । হীরমনের রাম-রূপ দর্শন, ঠাকুর হরিচাঁদের সহিত গোস্বামী লোচনের মিলন, গোস্বামী গোলকচাঁদের চতুর্ভূজ রুপ দর্শন, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের উপাখ্যান, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পদে রামচাদের পদ্ম দর্শন, কলমদাস বৈরাগীকে কৃষ্ণ রুপ দেখানো ইত্যাদি আরো অসংখ্য ঘটনা ঠাকুরের পুর্নতার বহিঃপ্রকাশ । এছাড়াও তার মুখের কথায় কত অপুত্রক পুত্র পেল, কত মরা বাঁচল, কত অন্ধ ফিরে পেল তার দৃষ্টি শক্তি, কত রোগী রোগ মুক্ত হলো তার হিসেব মেলা ভার । এসব অসম্ভব ঘঠনা প্রতক্ষ্য করে মানুষের বিশ্বাস ক্রমেই বাড়তে লাগলো, দলে দলে মানুষ তাঁর কাছে ছুটে আসতে লাগলো । শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্হে ঠাকুরের অলৌকিক লীলা সামান্যমাত্র বর্নীত হয়েছে । বহু ঘটনা আজো মানুষের অজানা ও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে । ঠাকুর হরিচাঁদ আত্মপ্রচার পছন্দ করতেন না । তাঁর ঘটনাবহুল জীবনী কিছু লেখা সত্বেও ঠাকুরের অনিচ্ছার কারনে দৈবযোগে হারিয়ে যায় । এই ঘটনা শ্রীশ্রীহরীলীলামৃত গ্রন্হে -গ্রন্হ রচনার ইতিবৃত্ত- নামক আখ্যানে বর্নীত আছে । কিছু ঘটনা লেখার পর যখন ঠাকুরকে পড়ে শোনানো হয় তখন ঠাকুর বলেন--
ক্ষান্ত কর লেখলেখি বাহ্য সমাচার,
অন্তরের মাঝে রাখ আসন আমার ।।
হেন কালে দৈবযোগে লীলাগ্রন্হ খানি,
আপনি হরিয়া লন দেবী বীনাপানি ।।
পরবর্তিকালে ঠাকুরের কৃপাদেশে কবি রসরাজ তারক চন্দ্র সরকার শ্রীশ্রীহরীলীলামৃত গ্রন্হ রচনা করেন ।
ইটকাঠের শহরের বাইরে যে বাংলা -বিশাল বাংলা- সেই নদী বিধৌত সবুজে আজও পবিত্র প্রাণ অনন্তের স্বর্গীয় দূতের আবির্ভাব হয়। তাঁরা গানে গানে মূখর করে তোলেন বাংলার পথ ও প্রান্তর- মনে করিয়ে দেন আবহমান বাংলার প্রেম ও ভক্তিমূলক শ্বাশত বাণী। যুগ যুগ ধরে লোকজ বাংলার জনমানুষ অপেক্ষা করে থাকে কখন তেমনি এক স্বর্গীয় দূতের আবির্ভাব হয়। তেমন হলে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে নেবে। তারপর সে অলীক জন্মের পর পবিত্র প্রাণটি মুঠো মুঠো সাদা খই ছড়ায়ে হেঁটে বেড়ান গ্রাম্য প্রান্তরের পথে। গান গান। তাঁর গানে কাতর হয় পাখি। এক সময় দূরের নক্ষত্রের ইশারায় দূর নক্ষত্রের দেশে তিনি হারিয়ে যান। তারপর তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তী। তারপর মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাঁর অলৈকিক বৃত্তান্ত। দক্ষিণ বাংলার হরিচাঁদ ঠাকুর সেরকমই একজন।
দক্ষিন বাংলায় পৃথিবীখ্যাত একজন রাজনৈতিক নেতার জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু। দক্ষিন বাংলায় পৃথিবীর শুদ্ধতম একজন কবির জন্ম হয়েছে। জীবনানন্দ। দক্ষিন বাংলায় বিশ্বমানের একজন আধ্যাত্মিক নেতার জন্ম হয়েছে। যার নাম বাংলাদেশের মূলস্রোতে আলোচ্য নয় । এই আক্ষেপ। আজ এই আক্ষেপ খানিক দূর করি। হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম দক্ষিণ বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি গ্রামে। পিতা যশোমন্ত ঠাকুর ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ এবং নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। ১৮১১ সনের ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় ত্রয়োদশীতে তাঁর ঘর আলো করে একপুত্র সন্তান জন্মাল। যশোমন্ত ঠাকুর পুত্রের নাম রাখলেন হরি। ফুটফুটে শিশু। দিনে দিনে বড় হতে লাগল শিশু হরি। বালকবয়েসে সম্ভবত বালক হরির ওড়াকান্দির পাঠশালায় যেতে ভালো লাগত না। না লাগারই কথা। যিনি সমস্তই জানেন পাঠশালায় তিনি কী শিখবেন! মধুমতি নদীটি বাড়ির কাছেই । বালক ধূলোমলিন পথে হাঁটে। একা। হাঁটে আর তার ভিতরে এই বোধ জন্ম লয়:
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল ... (মৃত্যুর আগে। জীবনানন্দ দাশ)
বালক হাঁটে। হাঁটে আর তার ভিতরে এইসব বোধ জন্ম লয়। নদীর ধারে প্রান্তর। প্রান্তরের ওপর আশ্বিনের ফিরোজা রঙের আকাশ। প্রান্তর ঘিরে নীল সবুজ গাছপালা। বুনো কেতকীর ঘ্রান। ঘুঘুর ডাক। বালক দ্রুত হাঁটে। মাধব অপেক্ষা করছে। মাধব রাখাল। রাখাল মাধব হরির বন্ধু। হরির রাখাল বন্ধু। হরি গোরু প্রান্তর আর রাখাল বালকেরে ভালোবাসে। ভালোবাসে তালতমালের বন, রোদ, গাছের ছায়া, পূর্বাহ্নের প্রান্তরের নীরবতা, উদাস দুপুর, ডাহুকের ডাক, হাম্বাধ্বনি। হরি বাংলার মাঠপ্রান্তর ভালোবাসে। মাঝিপাড়ার শ্যামলও তার বন্ধু। সে আর শ্যামল গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে । বালক হরির চোখে বিস্ময়। মানুষের ঘরবাড়ি রোদ কলাগাছ। মৈথিলী ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান বালক হরি। তাতে কী। সমাজে যে কত রকমের ভেদ। হরি উচুঁ নীচু সকল দলের সঙ্গেই মিশে যে! ফুটফুটে বালক। অন্যরকম। মধুর ব্যবহার ! লোকে আকৃষ্ট হয়। পরোপকারী । এক দিন ... লোকে ভাবে: 'বামুনের ঘরে জন্ম-চন্ডালের হাতে জল খায়। এ সাক্ষাৎ ভগবান।' হরি গান ভালোবাসে। রাত জেগে নামকীর্তন শোনে। গানের ব্যপারটা বোঝে সে। বিশেষ করে ভজন। বয়স বাড়ছে হরির। সঙ্গে সঙ্গে ভাবুকতাও বাড়ছে। এক বর্ষায় বাবার সঙ্গে নদীয়ার মায়াপুর থেকে ঘুরে এল। এক ফুটফুটে জোছনারাতের চাতালে শুয়ে আছে। ঘুমের ভিতরের স্বপ্নে দেখা দিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব! তরুণ হরির ঘুম ভেঙ্গে গেল। যা বোঝার ছিল বুঝল। ঠিক করল:ওড়াকান্দি ফিরে শ্রীচৈতন্য যা যা প্রচার করে গেছেন সেও তাই প্রচার করবে। তারপর ওড়াকান্দি ফিরে চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তির কথা সহজসরলভাবে প্রচার করতে লাগল হরি। কখন যে সেসব তার নিজের কথা হয়ে যায়!
২
চৈতন্যদেবের কথা বলতে বলতে হরিচাঁদ মাতোয়ারা হয়ে যেতেন। তারপর তিনি যা যা বললেন সে সবই কালক্রমে হয়ে গেল মতুয়াবাদ। যিনি হরির কথায় মাতোয়ারা হন তিনিই মতুয়া। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া হরিনামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন তিনিই মতুয়া। লোকে তাঁর অনুসারীদের বলল মতুয়া। স্থানীয় ভাষায়: মউত্তা। কত যে শিষ্যশিষ্যা ভিড় করল ওড়াকান্দি গ্রামে। তারা প্রায় প্রত্যেকেই নিম্নবর্গীয় শ্রেণির। ভক্তরা হরিচাঁদকে বিষ্ণুর অবতার মনে করল। তাঁরা নেচে নেচে গাইল-
রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ।
হরিচাঁদের নাম কখন যে হয়ে গেল হরিচাঁদ ঠাকুর। দূরদূরান্ত থেকে তাঁর কাছে শিষ্যরা আসে। শিষ্যারাও। শিষ্যরা বলে-জ্ঞান দেন প্রভূ। হরিচাঁদ ঠাকুর বলেন, বৈদিক ক্রিয়াকর্মে আস্থাশীল হওয়া ঠিক না। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হওয়াই যুক্তিসম্মত। জীবনের লক্ষ হইল প্রেম ও ভক্তি দ্বারা হরির সাধন । আর সাধনমার্গে নারীপুরুষের অধিকার সমান । এই কথায় সমবেত ভক্তবৃন্দের মাঝে গুঞ্জন উঠল। হ্যাঁ, নারীপুরুষ নির্বিশেষে প্রেমধর্মের প্রচার করতে পারে। হরিচাঁদ ঠাকুরের কন্ঠস্বরে দৃঢ়তা। তিনি আরও বললেন, মতুয়া ধর্মের প্রচারককে বলবা গোঁসাই। মাধবী নামে এক সদ্য বিধবা তরুণী উঠে বলল-আমি গোঁসাই হব ঠাকুর। তুমি গোঁসাই হবে? -সে তো ভালো কথা মা। হরিচাঁদ ঠাকুরের কন্ঠে আনন্দধ্বনি। মতুয়া সম্প্রদায়ের নারীরা হরিচাঁদ ঠাকুরকে যা বলার বলেছিল। কাজেই, হরিচাঁদ ঠাকুর বিবাহকে উৎসাহিত করলেও বাল্যবিবাহের কঠোর বিরোধীতা করলেন। ১৮৭৭ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যু। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু ১৮৯১। বিধবা বিবাহের বিষয়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের বক্তব্য কী ছিল -সে বিষয়ে জানা না গেলেও বাল্যবিবাহের কঠোর বিরোধীতা তাঁর সমাজচেতনার প্রমান। যাক। হরিচাঁদ ঠাকুর ভক্তদের বললেন, মতুয়া ধর্মের ভিত হইল প্রেম সত্য ও পবিত্রতা। আর, সকল মানুষ সমান। আমরা হইলাম জাতিভেদ বিরোধী। বোসছো। আমরা সক্কলে নিুবর্গীয়। তাই থাকমু। যাক, অনেক কথা হইল। এখন গান ধরো কেউ। হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রর্থনাসভায় অনিবার্য ছিল গান। গান ভক্তরাই রচনা করত। সেই গানকে এখন বলা হয় মতুয়া সঙ্গীত। সে গানে থাকত হরিনামের মাহাত্ম । কখনও কখনও হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রশংসাও থাকত। ভক্তরা হরিচাঁদকে বিষ্ণুর অবতার মনে করে। সে রকম একটি গানের চরণ এইরকম:
হরি তোমার নামের মধু পান করল না মন-ভ্রমরা
গানে প্রেম ও ভক্তিরসের প্রাধান্য। প্রতিটি গানের শেষে ভনিতায় রচয়িতার নাম আছে। ভক্তরা নেচে নেচে গান পরিবেশন করে। গানের সঙ্গে সঙ্গে বাজে ঢাক, শিঙ্গা ও ঝাঁঝর। গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে অনেকেই মূর্চ্ছা যায় ... কী সুখ কী সুখ -এই সম্মিলিত জীবনের। এদের রাত নির্ঘূম কাটে না। এরা শাকভাতেই সুখি। এদের ঘুমের অষুধ খেতে হয় না। এরা ঘুমের সুখ পায়। যে কারণে এরা বিচ্ছিন্ন ও ধনী হতে চায় না। এরা দীঘির অতল রহস্য বোঝে ও দীঘির অতল রহস্য ভালোবাসে। এরা জানে: সুইমিংপুলে রহস্য নাই। যে কারণে এরা সুইমিংপুল চায় না। (সুইমিংপুল চিনেও না)। এরাই বাংলা- বাংলাদেশ ... কাজেই বাংলা কখনও ধনী হবে না। এখানে গানওয়ালা স্বর্গীয় দূতের জন্ম হয়। যারা দান করেন গান (ধন নয়) ও সম্মিলিত জীবনের সুখ। এদের আগমন সম্ভব করার জন্য বাংলার অবারিত প্রান্তর রাখাল আর দীঘি থাকবে। চিরকাল। বাংলা কাজেই কখনও ধনী হবে না। বিচ্ছিন্ন অসুখি ও ধনী হবে না।
৩
১৮৪৭ সালের নভেম্বর মাসে কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার জন্ম নড়াইল জেলার জয়পুর গ্রামে । কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের একজন ভক্ত। হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন ও আদর্শ নিয়ে কবিয়াল শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ রচনা করেন। এটিই মতুয়াদের পবিত্র গ্রন্থ। এই গ্রন্থ পাঠ ছাড়াও মতুয়ারা হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা মেনে চলে।
হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা:
১/ সদা সত্য কথা বলবে। ২/ পিতা-মাতাকে দেবজ্ঞানে ভক্তি করবে। ৩/ নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে। ৪/ জগৎকে ভালোবাসবে। ৫/ সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে। ৬/ জাতিভেদ করবে না। ৭/ হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। ৮/ প্রত্যহ প্রার্থনা করবে। ৯/ ঈশ্বরে আত্মদান করবে। ১০/ বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না। ১১/ ষড়রিপু বশে রাখবে। এবং ১২/ হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।
হরিচাঁদ ঠাকুর সন্ন্যাস-জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না; তিনি সংসার করেছেন। ১২ সংখ্যক আজ্ঞাটি লক্ষ করুন। সংসারধর্ম পালন করেই ঈশ্বরপেমের বাণী প্রচার করেছেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনি বলতেন-
গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয় সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।
১৮৭৭ সালের ২৩ ফাল্গুন। বুধবার। হরিচাঁদ ঠাকুর ইহলীলা সংবরণ করেন।
৪
মতুয়ারা বাংলাদেশের সব জায়গায় বাস করে। এমন কী পশ্চিমবঙ্গেও। মতুয়াদের প্রধান মন্দিরটি ওড়াকান্দি গ্রামে। জন্মতিথিতে প্রতিবছর ওড়াকান্দিতে দেশবিদেশের মতুয়ারা সম্মিলিত হন এবং হরিচাঁদ প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পশ্চিমবাংলার মতুয়ারা সীমান্ত পার হয়ে আসে। আসলে সীমান্ত পার হয়ে আসে না। বাংলা বরাবরই একই রকম রয়ে গেছে। মতুয়াদের সম্বন্ধে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন: : The community observes Wednesday as the day of communal worship. The gathering, which is called 'Hari Sabha' (the meeting of Hari), is an occasion for the Matuya to sing kirtan in praise of Hari till they almost fall senseless. musical instruments such as jaydanka, kansa, conch, shinga, accompany the kirtan. The gonsai, garlanded with karanga (coconut shell) and carrying chhota, sticks about twenty inches long, and red flags with white patches, lead the singing. (বাংলাপিডিয়া)
৫
এবং আমরাও ফেব্রুয়ারি মাসে কাশিয়ানীর ওড়াকান্দিতে যেতে পারি। আমরা ওখানে গেলে আমাদের মনের নিরানন্দভাব কাটতে পারে। আমরা যদি ওড়াকান্দিতে না যাই তো মতুয়াদের কী ক্ষতি হবে? ক্ষতি যা হবার আমাদেরই হবে। আমাদের মনের ক্ষতি হবে। বাংলার এখন এক মহাবিপর্যয় চলছে। বাংলা তার একান্ত ভাবদর্শন হারাতে বসেছে! যখন পশ্চিমের অনেকেই বাংলার আধ্যাত্মিক দর্শনের দিকে ঝুঁকছে-আমরা তখন ওদের দিকেই ঝুঁকছি। ঔপনিবেশিক শোষনে বাংলা তার 'ধন' হারিয়ে আর্তনাদ করেনি-এখন নয়া ঔপনিবেশিক শোষনে 'ভাব' হারিয়ে আর্তনাদ করছে। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন এখন 'নিউ এজ' দর্শনে এসে ঠেকেছে। নিউ এজ দর্শন যেমন আধুনিক পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতি গবেষনায় কৌতূহলী- তেমনি এটি গভীর আধাত্ব্যবাদী। নিউ এজ দর্শন যুক্তির ভারে আচ্ছন্ন মানুষের মনের নিরানন্দ ভাব কাটাতে সাহায্য করছে। বলে রাখি, পৃথিবীর নিরানন্দ মানুষের জন্য যা যা দরকার- তার সবই আছে ওড়াকান্দি গ্রামের হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনসাধনায়।
সূত্র: বাংলাপিডিয়া।
ওড়াকান্দির মেলা - অনুপম হীরা মণ্ডল
মধুকৃষ্ণা ত্রয়দশী তিথি। অর্থাৎ চৈত্র মাসের অমাবস্যার পূর্ববর্তী ত্রয়দশী তিথি। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রাম লোকে লোকারণ্য। ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়ির দিকে মানুষ সদল বলে ছুটছে। চারি দিক থেকে দলে দলে লোক আসছে ওড়াকান্দির দিকে। সবাই ছুটছে। দলে দলে লোক আসছে। জয়ডঙ্কা, ঝাঁজ, শিঙ্গা, শঙ্খ বজিয়ে তারা ছুটছে। হাতে তাদের লাল নিশান আর মুখে হরিবোল ধ্বনি। তাদের সকলের একটই উদ্দেশ্য ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়ি। প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়দশী তিথিতে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে একটি মেলা জমে। এই মেলার নাম ওড়াকান্দি মেলা। গ্রামের নাম থেকেই এই মেলার নামকরণ। এটিকে আবার মতুয়া মেলাও বলা হয়। মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মেলা বলে এই নামকরণ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলায় (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) মতুয়া নামে একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এই ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮) ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই মার্চ (মধুকৃষ্ণা ত্রয়দশী তিথি বুধবার, ২৯ শে ফাল্গুন ১২১৮ বঙ্গাব্দ) গোপালগঞ্জ জেলার সফলাডাঙ্গা গ্রামে এক নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ওড়াকান্দিতে তাঁর সাধন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ভক্তের নিকট গ্রামটি তীর্থভূমি হিসেবে খ্যাতি পেয়ে আসছে। ভক্তেরা শ্রীহরিচাঁদের জন্ম তিথিকে স্মরণ করে প্রতিবছর ওড়াকান্দি ধামে মিলিত হন। সেই থেকে প্রতিবছর ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের সমাগম এবং মেলা জমে। ওড়াকান্দি মেলা মতুয়াদের প্রধান মেলা। এটি বারুণী মেলা নামেও খ্যাত। এই মেলাকে মতুয়ারা আবার মহাবারুণী নামেও ডাকে। মতুয়া সম্প্রদায় মধুকৃষ্ণা ত্রয়দশী তিথিকে পবিত্র জ্ঞান করে। তাদের মতে এই তিথিতে তাদের আরাধ্য পূর্ণব্রহ্ম শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব ও তিরোভাব ঘটেছে। মতুয়ারা আরো বিশ্বাস করে এমনি এক মধুকৃষ্ণ ত্রয়দশী তিথিতেই হরিচাঁদ ঠাকুর বাল্য কালে অলৌকিক শক্তি প্রাপ্ত হন। বারুণী যোগ হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট একটি পুন্য তিথি। তাদের বিশ্বাস এই তিথিতে øান করলে পুন্য সঞ্চিত হয়। বারুণীর সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির সংশ্রব রয়েছে। হিন্দুপুরাণ মতে, দেব-অশূরের সমুদ্র মন্থনকালে ক্ষীরোদ সমুদ্র হতে চন্দ্র, সুধা, স্বধা, ধন্বন্তরি, অপ্সরা, উচ্ছৈশ্রবা, কৌস্তভ এবং লক্ষ্মীর সঙ্গে বরুণ-কণ্যা বারুণী উত্থিত হয়েছিলেন। এই পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হিন্দু সম্প্রদায় বারুণী যোগে øান করেন। এটি হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মের পর নতুনত্ব লাভ করে। বারুণী উপলক্ষে যে সকল স্থানে মতুয়া মেলার আয়োজন হয় তার মধ্যে ওড়াকান্দির মেলা উল্লেখযোগ্য। তবে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মের পূর্ব হতেই তাঁর জন্মস্থান সফলাডাঙ্গায় বারুণী øান ও মেলা অনুষ্ঠিত হতো। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেও তাঁর ভক্তদের নিয়ে এই মেলায় অংশ নিতেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র যজ্ঞেশ্বর ঠাকুর সর্বপ্রথম এই মেলাকে ওড়াকান্দিতে স্থানান্তরের প্রস্তাব করেন। সে প্রস্তাব অনুসারে মেলা ও বারুণী উৎসবটিকে হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৬-১৯৩৬) ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে স্থানান্তর করেন। সেই থেকে প্রতিবছর ওড়াকান্দিতে সপ্তাহ ব্যাপি মেলা জমে এবং লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভক্তের সমাবেশ হয়। মতুয়ারা ওড়াকান্দিকে তীর্থ স্থান বলে মনে করে। তাদের নিকট ওড়াকান্দি গ্রাম হলো পুন্যভূমি। তাদের মান্যগ্রন্থ শ্রী শ্রীহরি লীলামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে— ওড়াকান্দি গ্রাম তোমার শ্রীধাম পীঠ বলি জাতি মানে। প্রেম মেলা মেলে বাসন্তি হিল্লোলে শ্রীমহাবারুণী দিনে ॥ ওড়াকান্দির মেলা ওড়াকান্দি মেলা নিয়ে ভক্তদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এই মেলাকে কেন্দ্র করে অজস্র সাধক-কবি পদ রচনা করেছেন। তাঁরা পদ রচনার মধ্য দিয়ে এই মেলা এবং ওড়াকান্দি ধামের মাহাত্ম বর্ণনা করেছেন। তারা মনে করেন ওড়াকান্দি গিয়ে মনত করলে মনের বাসনা পূর্ন হয়। তাই সাধক কবি বলেছেন— শ্রীধাম ওড়াকান্দি যাবি যদি গৌণ করো না গৌণ করো না আমার মন অলস হলো না । গেলে ধর্ম অর্থ মোক্ষ ফলে ফলের কে করে গণনা ॥ এই মেলায় মতুয়াদের হরিসংকীর্তন হয়। খোল-করতাল, একতারা, প্রেমজুড়ি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে মতুয়া গায়কেরা গান করেন। সঙ্গে চলে মন্দির প্রদক্ষিণ। গানের সঙ্গে চলে মাতন। মেলের একপাশে দেশের অন্যান্য স্থানের সাধু ভক্তদের জন্য নির্ধারিত স্থান থাকে। এছাড়া ঠাকুর বাড়ির প্রাঙ্গন জুড়ে থাকে ধর্মীয় গ্রন্থের সমারোহ। সাধক-ভক্তেরা তাদের প্রয়োজন মতো এখান থেকে বই সংগ্রহ করে। মতুয়া ধর্ম সংক্রান্ত সকল বই মেলায় পাওয়া যায়। মতুয়া ধর্ম সংক্রান্ত নতুন নতুন বই মতুয়াদের প্রধান আকর্ষণের বিষয়। এছাড়া এই মেলার পুরো আয়োজনটাই শ্রমজীবী মানুষকে দারুণভাবে অকৃষ্ট করে। তাদের সারা বছরের উৎপাদিত দ্রব্য যেমন এই মেলায় বিক্রি করতে পারে তেমনি তাদের প্রয়োজন মতো দ্রব্যও কিনতে পারে। মেলার এক পাশে বসে খাবারের দোকান। অন্য পাশে পুজার উপকরণ, কাঠমিস্ত্রির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, রাজমিস্ত্রির হাতিয়ারপত্রের সমারোহ ঘটে। মেলার অন্য পাশে থাকে কামার, কুমার, তাঁতীদের উৎপাদিত দ্রব্য। এক দিকে বসে মাছের বাজার। এছাড়া সব্জী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও সমাবেশ ঘটে। এর বাইরে অন্য একটি স্থানে জমে পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রাদল, নাগর দোলার আসর। কৃষ্ণকদের সারা বছরের প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ এই মেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। এছাড়া মতুয়া ভক্তেরা তাদের বাদ্যযন্ত্র ডঙ্গ, শিঙ্গা, হারমোনিয়াম, খোল, প্রেমজুড়ি, একতারা এই মেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। বাংলাদেশে যে কয়টি কৃষি মেলা আছে ওড়াকান্দি মেলা তাদের মধ্যে সর্ববৃহৎ মেলা। দিনকি দিন এই মেলার প্রসার বাড়ছে বৈ কমছে না। মূলত মানুষের প্রয়োজনেই মেলা আরো জীবন্ত হয়ে উঠছে। http://www.shapludu.com/1418/01/article_details.php?article_serial=32
লিত মানুষের ত্রাণকর্তা
ইরানী বিশ্বাস
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার একটি ইউনিয়ন ওড়াকান্দি। প্রায় দুশো বছর আগে ১২১৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে (1812 সালের ১৩ মার্চ ওড়াকান্দির পার্শ্ববর্তী সাফলিডাঙ্গা গ্রামে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। যশোবন্ত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ছিলেন। বৈষ্ণবভক্ত হিসেবেও এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। জন্মের সময় তাঁর শরীরে বত্রিশ রকমের লক্ষণ ছিল, যা হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী অবতার পুরুষের বিশেষ লক্ষণ। এই লক্ষণগুলি গৌতম বুদ্ধের শরীরেও ছিল।
অনেকেই মনে করেন হরিচাঁদ ঠাকুর আসলে বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার। অল্পদিনের মধ্যেই এই বিশেষ লক্ষণ হরিচাঁদ ঠাকুরকে অবতারপুরুষ হিসেবে প্রচারের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষ্ণবীয় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন তাতে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর পিতা ও পিতার সতীর্থদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বৈষ্ণবীয় পরিবেশে অবস্থান করার সুযোগে বিভিন্ন শাস্ত্রালোচনায় অংশগ্রহণ এবং প্রাসঙ্গিক শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। একই প্রক্রিয়ায় তিনি দেশীয় চিকিৎসা ও ভূমিব্যবস্থাসহ নানা ধরনের ঐতিহ্যিক জ্ঞানে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।
প্রথম জীবনে হরিচাঁদ ঠাকুর মাঠে গরু চরাতেন। বয়সের সাথে সাথে তিনি কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। তবে অবতারপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে তিনি সক্রিয় হন ভক্তদের মনরক্ষার কাজে। এ সময় সাফলিডাঙ্গা ছেড়ে ওড়াকান্দিতে বসবাস শুরু করেন। অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি ভক্তদের রোগ থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন কল্যাণসাধন করতেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। হরিভক্তদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়াদের ভক্তি ও হরিচাঁদ ঠাকুরের শক্তি এ দুয়ে মিলে ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে দেশে দেশে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বর্তমানে ওড়াকান্দি একটি তীর্থধামে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ভক্তদের ধারণা, হরিচাঁদ ঠাকুর মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্মতিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় ওড়াকান্দিতে।
হরিচাঁদের ধর্মদর্শন ছিল সমন্বয়বাদী। তবে সমকালে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীতে বৈষ্ণব আদর্শের যে ধারা প্রচলিত ছিলো সেটাই সর্বাধিক জায়গা দখল করে আছে এখনো। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান করাকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অবতার গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বলা যায় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিষয়টি তাঁকে বিশেষভাবে প্ররোচিত করেছিলো। প্রচলিত ধর্মশাসন পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব এবং আন্তরিকতাহীন অভিহিত করে হরিচাঁদ ঠাকুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সংসারের কর্মযজ্ঞের মধ্য থেকেই ধর্মকর্ম করা সম্ভব। যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা বাহুল্যমাত্র। ভক্তদের প্রতি তাঁর প্রধান উপদেশ ছিল, 'হাতে নাম মুখে কাজ'।
বিবিধের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারার যে মহৎ গুণ বাঙালির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য, মতুয়া আদর্শের মধ্যে তা লক্ষণীয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মনীষী মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। দলিত মানুষের জন্য অনেক কাজ করার বাসনায় মৃত্যুর পূর্বে হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরকে। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ভক্তরাও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে হরিচাঁদের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁর উপাধি দেন 'হরিগুরুচাঁদ'।
ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মতই ভারত ইতিহাসেরও আছে দুটি স্বতন্ত্র স্তর। একটি উঁচুতলার, অন্যটি নীচুতলার। নীচুতলার ইতিহাস আজো অন্ধকারে নিমজ্জিত। উঁচুতলার মানুষ ঘৃণায়-অবহেলায় সে ইতিহাসকে গুরুত্ব দেবার তেমন প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু ভারতীয় সমাজবদলের ক্ষেত্রে এ ইতিহাসের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আর গুরুচাঁদ শুধু পিছিয়েপড়া হিন্দু জাতির জন্য কাজ করেননি। তিনি মূলত মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখতেন। তার কাছে কোনো জাতিভেদ ছিল না। তাই তাঁর পরমপ্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন খুলনার তিনকড়ি মিঞা। তার নাতি জালালউদ্দিন বর্তমানে মতুয়া দলপতি। বিদেশি দম্পতি ডা. এস এস মিড তাকে ডেকেছিলেন ধর্মপিতা।
ধর্মযোগী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়াধর্মের মাধ্যমে অবহেলিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। তখনকার দিনে শিক্ষাবিস্তারের সুযোগ ছিল কম। তবু তাঁর এ ব্যপারে তীক্ষè দৃষ্টি ছিল এবং নিজ পুত্র গুরুচাঁদকে শিক্ষার প্রসারে প্রয়াস নিতে নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুচাঁদও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর কাছে যিনিই আসতেন তাকে বলতেন, সন্তান যেন অশিক্ষিত না থাকে। সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারলেই আমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে।
এ আন্দোলন তিনি শুধু নিজ সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তেলি, মালি, কুম্ভকার, কাপালি, মাহিষ্য সব সম্প্রদায়ের জন্যই কাজ করে গেছেন। কোথাও স্কুল স্থাপিত হলে তার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা। উচ্চবর্ণ যখন সমাজ-অধিপতি ঠিক সে সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর দলিত মানুষের শিক্ষা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। দলিত নমঃশূদ্র জাতি শিক্ষালাভ করবে এটা মোটেই সমুচিত ছিল না সে সময়ে। তবু গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন তার লক্ষ্যে অটল। যাবতীয় বাধাবিঘœ কাটিয়ে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে তিনি প্রথম স্কুল স্থাপন করেন। এটা কোনো রাজা-মহারাজার কাজ নয়। দলিত সমাজের সাধারণ একজন মানুষ নিজের জাতির কথা চিন্তা করে নিজের উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ স্কুলেই প্রথম তিনি ছাত্রবৃত্তি চালু করেন। পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরে এটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয়। তিনি বুঝেছিলেন, বর্ণহিন্দুর শিক্ষার ব্যাপারে কোনোরূপ সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাই তিনি খ্রিস্টান মিশনারি ড. মিডের সহায়তা নেন এবং সরকারি সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন।
১৮৮১ সালে খুলনার দত্তডাঙ্গায় এক নমঃশূদ্র মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বর গায়েনের বাড়িতে। সেখানে দলিত সমাজে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় সম্বন্ধে তিনি শতাব্দীর সেরা ভাষণ দেন। এর পর থেকেই তিনি একের পর এক স্কুল স্থাপন করতে থাকেন। তার দেখাদেখি চারিদিকে স্কুল খোলার ধুম পড়ে যায়। এসব নতুন স্কুলে শিক্ষাদান করতেন হাই ইংলিশ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। এই ভাবে দুর্গম অনুন্নত সুন্দরবন অঞ্চলেও শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়।
দলিত জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেমন আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর, তেমনি চাকরিক্ষেত্রেও তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তার ফলে বিশ শতকের প্রথম দশকেই অর্থাৎ ১৯০৯ সালে শিক্ষা, চাকরি ও পরবর্তীকালে আইনসভায় আসন সংরক্ষিত হয়েছিল। এমনকি তারা তফশিলভুক্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
গুরুচাঁদ নিজের পুত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম পুত্র শশীভূষণ লক্ষ্মীপাশা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি প্রথম 'নমঃশূদ্র সুহৃদ' পত্রিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সাথে কর্মক্ষেত্র লাভের আন্দোলনও শুরু করেছিলেন। তৎকালে গুরুচঁদের নেতৃত্বে পাঁচ সহচারীকে নিয়ে তিনি ছোটলাটের কাছে দেখা করেন। সেখানে তাঁরা জানান, সামাজিক অবিচারের জন্য নমঃশূদ্রদের শিক্ষা প্রসারে ব্যহত হচ্ছে। তাই সরকারি পরিষেবায় নিয়োগের বিশেষ প্রয়োজন। এর পরে শশীভূষণ নিযুক্ত হন সাব-রেজিস্ট্রার, ডা. তারিণী চরণ বালা সরকারি ডাক্তার এবং কুমুদ বিহারী মল্লিক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। এটাই ছিল প্রথম কোনো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সরকারি কাজে যোগদান।
১৯৩২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর 'শ্রীশ্রীহরি-গুরু মিশন' স্থাপন করেন। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পাঠশালা, স্কুল ও ছাত্রাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এই মিশনের উদ্যোগে তিনি তালতলাতে 'শান্তি-সত্যভামা বালিকা বিদ্যালয়' নামে মেয়েদের একটি আলাদা স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া মিসেস মিডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই মেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। প্রসূতি মা ও শিশুসেবার জন্য নির্মিত হয় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, যা আজও ওড়াকান্দিতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দলিত মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের খরচে তারিণী বালাকে এমবিবিএস পড়িয়েছিলেন। আপন পৌত্র মন্মথ ঠাকুরকেও এমবিবিএস পড়ান। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে পায়খানা তৈরি ও পানীয় জলের পুকুরকে আলাদা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মনীষী যে আধুনিক চিন্তা করেছিলেন, আজও তা অব্যাহত রয়েছে মানবসমাজে।
১৯১৯ সালেই নতুন ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। এরই ফলে বাংলার বিধান পরিষদে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান গুরুচাদের অনুসারী ভীষ্মদেব দাস। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে ১৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন অস্পৃশ্য সমাজের। এরা ছিলেন ভীষ্মদেব দাস ও নিরোদবিহারী মল্লিক। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও বিধান পরিষদে মনোনীত হতে পেরেছিলেন শুধু গুরুচাঁদ ঠাকুরের কারণে।
শুধু শিক্ষাবিস্তারেই এই মনীষী থেমে থাকেননি, সমাজ উন্নয়নেও অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা এই যুগের নিরিখে অতি ত্চ্ছু মনে হলেও সেই সময়ে ছিল বিস্ময়কর সমাজকল্যাণমূলক কাজ। 'নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি' গুরুচাঁদ ঠাকুরের এমনই একটি মহৎ কাজ। কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি 'মিলা'র সৎ কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হতো এই সমিতি। এর উদ্যেশ্য ছিল বহুমুখী। শিক্ষাবিস্তার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মজাপুকুর খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৎ উপায়ে জীবনধারণ করা, মানুষকে সাহায্য করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শাক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ 'লক্ষ্মীর গোলা' গঠন করেছিলেন। মরসুমের সময়ে ধান সংগ্রহ করে এ গোলায় রাখা হতো। দাম বাড়লে বিক্রি করে বিভিন্ন সামাজিক উপকরণ কেনা হতো। কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের সময় এই ধান গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হতো। আবার কখনো কখনো গোলার ধান ধারে দেওয়া হতো। তবে ফেরত দেয়ার সময় এক মণ ধানে ১০ সের বেশি দিতে হতো। এটা আসলে গ্রামীণ ব্যাংকিং পদ্ধতি ছিল। গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন বিচক্ষণ। তার চিন্তাচেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি স্বনির্ভরতা অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থ ছাড়া মুক্তি নেই। তিনি সবসময় বলতেন, অর্থ হলো চঞ্চলার ধন, যতœ না করলে ধরে রাখা যায় না। অর্থ ছাড়া অর্থ আসে না। তাই সমবায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাজনি কারবার করে ধনসম্পদ তথা মূলধন বৃদ্ধির উপদেশ দিতেন ভক্তদের। বাণিজ্যতরী নির্মাণ করে সেই নৌকায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করার পদ্ধতিকে তিনি মহাজনি কারবার বলতেন।
১৮৫৮ সালে কৃষক বিদ্র্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এ সময় শক্তিশালী জমিদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন মূলত দলিত পিছিয়ে পড়া সমাজের পথিকৃৎ। তিনি এই পিছিয়ে পড়া সমাজকে শিক্ষার আলো জ্বেলে অগ্রগামী করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। এসব দলিত মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন।
কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি। তারা এখনো নৌকায় চড়ে স্কুলে যায় শিক্ষালাভের জন্য। নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, যানবাহন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। এমনকি অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। আমাদের মাঝে আরো একজন গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম নেওয়া খুব জরুরি, যিনি ভাগ্যবঞ্চিত এসব মানুষকে উদ্ধার করবেন ।
খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডা. সি এস মিড গুরুচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, সারা ভারতবর্ষের প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের মধ্যে তার মতো একজন দূরদৃষ্টি ও তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন এবং অমিত তেজস্বী মানুষ দেখেননি তিনি। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু। প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে তিনি দিন বরুনীমেলা অ&#
ফেরদৌস একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করবেন। ছবির নাম 'হরিচাঁদ ঠাকুর'। রাজনৈতিক বিচারেও এই ছবির গুরুত্ব বেশ। কারণ ভারতের মতুয়া সম্প্রদায় এই ছবির বিষয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকায় ফেরদৌস। নিত্যদিন তার কলকাতা-বাংলাদেশ-রামোজি ফিল্ম সিটি যাতায়াত এতদিনে বোধহয় অন্য মাত্রা পেল সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিচারে।
ফেরদৌস বললেন, 'হরিচাঁদ ঠাকুর-গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রায় লাখ লাখ ভক্ত আছেন আমি জানি। এ সম্প্রদায়ের জন্য হরিচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করাটা আমার সৌভাগ্য। একেবারে মতুয়াদের খাসতালুকে গিয়ে শুটিং হয়েছে। চাকদহ, কৃষ্ণনগর গিয়েছি আমরা। পুঁথি ঘেঁটে ছবিটা অথেনটিক করার চেষ্টা করেছি'। এই ছবিতে ফেরদৌস ছাড়াও অভিনয় করেছেন পাপিয়া অধিকারী, মনোজ মিত্র, দুলাল লাহিড়ী, মনু মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, অমৃতা চট্টোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ বণিক। অন্যদিকে ফেরদৌস আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন। সঙ্গে আছেন শ্রাবন্তী আর জিৎ। তিনি বলেন, 'এই প্রথম শ্রাবন্তীর বিপরীতে কাজ করব।'
প্রশ্ন তুললেন গৌতম দেব রাজ্যের উন্নতির জন্য বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে আপত্তি কেন মুখ্যমন্ত্রীর
নিজস্ব প্রতিনিধি
কলকাতা, ১১ই মার্চ— গরিব মানুষের উন্নতির জন্য, পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির জন্য সরকার এবং বিরোধীপক্ষ একসঙ্গে কাজ করুক এটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন চান না? রাজ্যের উন্নয়ন, গরিব মানুষের উন্নয়নের জন্য বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি কোথায়? রবিবার মহাজাতি সদনে হরিচাঁদ ঠাকুরের দু'শো তম জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে এই প্রশ্ন তুললেন সি পি আই (এম)-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব। 'শ্রী শ্রী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর রিসার্চ ফাউন্ডেশন'-র পক্ষ থেকে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন না কেন? এনিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনো কথা বলছেন না কেন? কেন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পাওয়া, ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকের জন্য রাজ্যের বিরোধী দলগুলির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী একসুরে গলা মেলাবেন না?
গৌতম দেব বলেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন যাঁদের এদেশের মানুষ হিসাবে কোনো স্বীকৃতিই নেই। ১৯৭১সালের পরে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন। তাঁদের পরিচয় কী? তাঁরা এদেশে বসবাস করলেও তাঁদের নাগরিকের কোনো মর্যাদা নেই, আইনী অস্তিত্ব নেই। এমনকি উদ্বাস্তু মানুষ হিসাবেও কোনো স্বীকৃতি তাঁদের নেই। এই লক্ষ লক্ষ পরিচয়হীন মানুষকে এদেশের উদ্বাস্তু মানুষ হিসাবে, নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি এবং মর্যাদা দেওয়ার ন্যায্য দাবিতে রাজ্যের বিরোধী দলগুলির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর দল কেন একসুরে গলা মেলাবেন না? এই প্রশ্নও তোলেন গৌতম দেব। তিনি বলেন, এই দাবি তো শুধুমাত্র মতুয়া সম্প্রদায় মানুষদের দাবি হতে পারে না। এই দাবি তো এই মুহূর্তে দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই কথাটাই আমরা তৃণমূলের সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছি। তাঁদের বলছি, তাঁদের দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জিকেও বলছি, আসুন সবাই মিলে একসঙ্গে এই গরিব অসহায় মানুষের এই দাবিগুলি তুলে ধরি।
একথা উল্লেখ করে গৌতম দেব বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতা তো থাকবেই। ওনারাও রাজনৈতিকভাবে আমাদের বিরোধিতা করবেন। ওনাদেরও আমরা রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করবো। তৃণমূল জোট সরকারের খারাপ পদক্ষেপের যেমন বিরোধিতা করবো, তেমনই সেই সরকারের ভালো কাজ করলে আমরা যে তাকে সমর্থন করবো সেকথাও তো আমরা বারেবারেই বলছি। 'শ্রী শ্রী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর রিসার্চ ফাউন্ডেশন'-র সভাপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা উল্লেখ করে গৌতম দেব আরো বলেন, ওনার এক ভাই তৃণমূলের মন্ত্রী। ওনারা একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আপনাদের মতো গরিব অবহেলিত মানুষদেরই তো উপকার হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা এই বিষয়টিই বুঝতে চাইছেন না। তাঁরা গরিব মানুষকে বিভক্ত করতে চাইছেন, গরিব-অবহেলিত মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছেন। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
এদিন হরিচাঁদ ঠাকুরের দু'শো তম জন্মদিনের এই অনুষ্ঠানে গৌতম দেব ছাড়াও ত্রিপুরার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী অনিল সরকার, সি পি আই (এম) নেতা কান্তি বিশ্বাস, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মোর্তাজা হোসেন, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বার্থে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন অনিল সরকার। তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেও হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। কান্তি বিশ্বাসও সমাজ সংস্কারক হিসাবে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। গৌতম দেব বলেন, দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগে সমাজ সংস্কারক হিসাবে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং পরে তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তাতে তাঁদের সেই ভূমিকার কথা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো উচিত। এই দাবিই আজ আমাদের তুলতে হবে। পিছিয়ে থাকা মানুষকে সামাজিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা যে সবার আগে করা উচিত তা অত বছর আগেও তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর ভক্তরা তাঁকে কোথাও যেতে বললে, গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁদের শর্ত দিয়ে বলতেন, আগে ওই এলাকায় পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য বিদ্যালয় খুলতে হবে। তারপর তিনি সেখানে যাবেন।
এদিনের এই অনুষ্ঠানে গৌতম দেব বলেন, রাজ্যে যখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল তখন ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে সেই সরকার গরিব ভূমিহীন মানুষের হাতে যে জমি তুলে দিয়েছিল, তাতে মতুয়ারাও উপকৃত হয়েছিলেন। কারণ, ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর মাধ্যমে যে ৩০লক্ষ পরিবারের হাতে জমি তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের ৫৭শতাংশই তফসিলী জাতি এবং আদিবাসী মানুষ। যাঁদের মধ্যে মতুয়ারাও আছেন। গৌতম দেব বলেন, এই অবস্থায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও আবেদন জানিয়ে বলছি, গরিব মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করুন।
এদিনের এই অনুষ্ঠানে স্মারক গ্রন্থ এবং শ্রদ্ধাঞ্জলি নামে দু'টি বই প্রকাশ করেন করেন গৌতম দেব। অনিল সরকার এবং কান্তি বিশ্বাসও প্রকাশ করেন দু'টি পৃথক বই। হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের ওপর একটি গানের সি ডি প্রকাশ করেন মোর্তাজা হোসেন। বক্তারা ছাড়াও কবি অমূল্য সরকার, কপিল বিশ্বাস, বাসন্তীবালা ঠাকুর, প্রকাশ মিস্ত্রির হাতে স্মারক উপহার তুলে দিয়ে তাঁদের সম্মান জানানো হয়।
দীপক রায় :: পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংগঠন মতুয়া মহাসঙ্ঘ। আর সেই কারনে এই রাজ্যের রাজনীতিতেও মতুয়া মহাসঙ্ঘের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রথমদিকে সেই রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের কারন ছিল মতুয়াদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া পুরন।
কিন্তু ক্রমশঃ সেই রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ মতুয়া মহাসঙ্ঘকে রাজনীতির পাঁকে আবদ্ধ করেছে। ক্রমশঃই স্পষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক বিভাজন। আর সেই বিভাজন সম্প্রতি মতুয়া মহাসঙ্ঘকে ঠেলে দিয়েছে ভাঙ্গনের পথে। গত ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মতুয়া মহাসঙ্ঘের ২৫ তম বার্ষিক সাধারন সভায় সেই ভাঙ্গন আরও স্পষ্ট হল। আর সেই রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকে মতুয়াদের শীর্ষ নেতৃত্বরা সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে কার্যকরী সমিতি গঠনের জন্য পৃথক প্যানেল তো পেশ করলেনই, খুনের অভিযোগও আনলেন পুলিশের কাছে গিয়ে। প্যানেলে মুখ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, সাংসদদের নাম থাকায় প্রশ্ন উঠেছে সাধারন মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের মানুষের মাঝে, মতুয়া মহাসঙ্ঘ আদৌ কি একটি সামাজিক সংগঠন, নাকি এখানেও তৈরি হয়েছে ক্ষমতা দখলের কুটিল রাজনৈতিক খেলা? যেহেতু এখন মতুয়াদের কেন্দ্র করে অঢেল সরকারী-বেসরকারি দানের অর্থের সুযোগ এসেছে, তাই কি এত ক্ষমতা দখলের লড়াই?
মতুয়া সম্প্রদায় মুলতঃ বাংলার হিন্দু শূদ্র বা নমঃশুদ্রদের সংগঠন। একসময় অবহেলিত ও লাঞ্ছিত, বঞ্চিত শূদ্র বা নমঃশুদ্র বা চণ্ডালদের সমাজে মর্যাদার আসনে বসাতে তৈরি হয়েছিল মতুয়া ধর্ম বা মতুয়া সম্প্রদায়। প্রায় ৪০০ বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি, যা বর্তমানে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার অধীন, সেখান থেকে এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছিলেন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। সেই সময় হিন্দুসমাজের বর্ণপ্রথার কারনে সর্বশেষ ধাপে এদের অবস্থান ছিল। জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে দিয়েই মতুয়া ধর্ম প্রবর্তন এবং শূদ্রদের মধ্যে তা গ্রহণের চল শুরু হয়েছিল। এর পেছনেও আছে গল্পের মতোই এক কাহিনি। আসুন জেনে নিই প্রায় ৪০০ বছর আগের এক কিংবদন্তি সেই কাহিনী।
ভারতের তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মৈথিলী ব্রাহ্মণ চন্দ্রমোহন ঠাকুর বেড়াতে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। তিনি ওড়াকান্দিতে এলে তাঁর সঙ্গে সেখানকার এক শূদ্র পরিবারের মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর ভালবাসার সম্পর্ক হয়েছিল। সেই সম্পর্ক থেকে তাঁরা বিয়েও করেন। যার ফলে সমাজপতিদের রোষানলে পড়েন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। তবে তিনি তখন এই ঘটনায় একটুও না দমে গিয়ে পূর্ববঙ্গের শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। এই চন্দ্রমোহনেরই উত্তরপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তন করেন মতুয়া ধর্ম। হরিচাদ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল ওড়াকান্দির সাফলিডাঙ্গা গ্রামে। তাঁর বাবা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। বৈষ্ণবভক্ত হিসেবেও এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। তাঁর ভক্তরা অনেকেই মনে করেন হরিচাঁদ ঠাকুর আসলে বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার। হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষ্ণবীয় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন তাতে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। বৈষ্ণবীয় পরিবেশে অবস্থান করার সুযোগে বিভিন্ন শাস্ত্রালোচনায় অংশগ্রহণ এবং প্রাসঙ্গিক শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। একইসাথে তিনি দেশীয় চিকিৎসা ও ভূমিব্যবস্থাসহ নানা ধরনের জ্ঞানে বিশেষ বুৎপত্তিও অর্জন করেছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি মাঠে রাখালি করতেন। পরে কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। তবে অবতারপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে তিনি সক্রিয় হন ভক্তদের মনরক্ষার কাজে। এ সময় সাফলিডাঙ্গা ছেড়ে ওড়াকান্দিতে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর ভক্তদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়াদের জন্যেই ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে চতুর্দিকে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বর্তমানে ওড়াকান্দি একটি তীর্থধামে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ভক্তদের ধারণা, হরিচাঁদ ঠাকুর মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্মতিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় ওড়াকান্দিতে এবং পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে। হরিচাঁদের ধর্মদর্শন ছিল সমন্বয়বাদী। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান করাকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অবতার গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বলা যায় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিষয়টি তাঁকে বিশেষভাবে প্ররোচিত করেছিলো। প্রচলিত ধর্মশাসন পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব এবং আন্তরিকতাহীন অভিহিত করে হরিচাঁদ ঠাকুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'সংসারের কর্মযজ্ঞের মধ্য থেকেই ধর্মকর্ম করা সম্ভব। যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা বাহুল্যমাত্র। হাতে নাম মুখে কাজই ধর্ম'। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মনীষী মাত্র ৬৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে। তিনিই মতুয়া ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ভক্তরাও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে হরিচাঁদের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁর উপাধি দেন 'হরিগুরুচাঁদ'। তাঁর পরমপ্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন খুলনার তিনকড়ি মিঞা। তার নাতি জালালউদ্দিন বর্তমানে মতুয়াদের দলপতি। বিদেশি দম্পতি ডা. এস এস মিড তাকে ডেকেছিলেন ধর্মপিতা। তখনকার দিনে শিক্ষাবিস্তারের সুযোগ ছিল কম। তবু তাঁর এ ব্যপারে তীক্ষ দৃষ্টি ছিল এবং নিজ পুত্র গুরুচাঁদকে শিক্ষার প্রসারে প্রয়াস নিতে নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুচাঁদও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর কাছে যিনিই আসতেন তাকে বলতেন, 'সন্তান যেন অশিক্ষিত না থাকে। সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারলেই আমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে'। এ আন্দোলন তিনি শুধু নমঃশূদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তেলি, মালি, কুম্ভকার, কাপালি, মাহিষ্য সব সম্প্রদায়ের জন্যই কাজ করে গেছেন। কোথাও স্কুল স্থাপিত হলে তার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা। দলিত নমঃশূদ্র জাতি শিক্ষালাভ করবে এটা মোটেই সমুচিত ছিল না সে সময়ে। তবু গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন তার লক্ষ্যে অটল। যাবতীয় বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে তিনি প্রথম স্কুল স্থাপন করেছিলেন। যা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ স্কুলেই প্রথম তিনি ছাত্রবৃত্তি চালু করেছিলেন। পরে এটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয় এবং সরকারি সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন। ১৮৮১ সালে খুলনার দত্তডাঙ্গায় এক নমঃশূদ্র মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বর গায়েনের বাড়িতে। সেখানে দলিত সমাজে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় সম্বন্ধে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এর পর থেকেই তিনি একের পর এক স্কুল স্থাপন করতে থাকেন। তার দেখাদেখি চারিদিকে স্কুল খোলার ধুম পড়ে যায়। এসব নতুন স্কুলে শিক্ষাদান করতেন হাই ইংলিশ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। এই ভাবে দুর্গম অনুন্নত সুন্দরবন অঞ্চলেও শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়। দলিত জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেমন আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর, তেমনি চাকরিক্ষেত্রেও তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তার ফলে বিশ শতকের প্রথম দশকে ১৯০৯ সালে শিক্ষা, চাকরি ও পরবর্তীকালে আইনসভায় আসন সংরক্ষিতও হয়েছিল। এমনকি তারা তফশিলভুক্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। গুরুচাঁদ নিজের পুত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম পুত্র শশীভূষণ ঠাকুর লক্ষ্মীপাশা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি প্রথম 'নমঃশূদ্র সুহৃদ' পত্রিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সাথে কর্মক্ষেত্র লাভের আন্দোলনও শুরু করেছিলেন। তৎকালে গুরুচাদের নেতৃত্বে পাঁচ সহচারীকে নিয়ে তিনি ছোটলাটের কাছে দেখা করেন। সেখানে তাঁরা জানান, 'সামাজিক অবিচারের জন্য নমঃশূদ্রদের শিক্ষা প্রসারে ব্যহত হচ্ছে। তাই সরকারি পরিষেবায় নিয়োগের বিশেষ প্রয়োজন'। এর পরে শশীভূষণ ঠাকুর নিযুক্ত হন সাব-রেজিস্ট্রার পদে, ডা. তারিণী চরণ বালা সরকারি ডাক্তার এবং কুমুদ বিহারী মল্লিক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। এটাই ছিল প্রথম কোনো নিম্নবর্ণের সরকারি কাজে যোগদান।
১৯৩২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর 'শ্রীশ্রীহরিগুরু মিশন' স্থাপন করেন। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পাঠশালা, স্কুল ও ছাত্রাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এই মিশনের উদ্যোগে তিনি তালতলাতে 'শান্তি-সত্যভামা বালিকা বিদ্যালয়' নামে মেয়েদের একটি আলাদা স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া মিসেস মিডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই মেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। প্রসূতি মা ও শিশুসেবার জন্য নির্মিত হয় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, যা আজও ওড়াকান্দিতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দলিত মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের খরচে তারিণী বালাকে এমবিবিএস পড়িয়েছিলেন। আপন পৌত্র মন্মথ ঠাকুরকেও এমবিবিএস পড়ান। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে পায়খানা তৈরি ও পানীয় জলের পুকুরকে আলাদা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মনীষী যে আধুনিক চিন্তা করেছিলেন, আজও তা অব্যাহত রয়েছে মানবসমাজে। ১৯১৯ সালেই নতুন ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। এরই ফলে বাংলার বিধান পরিষদে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান গুরুচাদের অনুসারী ভীষ্মদেব দাস। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে ১৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন অস্পৃশ্য সমাজের। এরা ছিলেন ভীষ্মদেব দাস ও নিরোদবিহারী মল্লিক। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও বিধান পরিষদে মনোনীত হতে পেরেছিলেন শুধু গুরুচাঁদ ঠাকুরের কারণে। শুধু শিক্ষাবিস্তারেই এই মনীষী থেমে থাকেননি, সমাজ উন্নয়নেও অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা এই যুগের নিরিখে অতি তুচ্ছ মনে হলেও সেই সময়ে ছিল বিস্ময়কর সমাজকল্যাণমূলক কাজ।
'নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি' গুরুচাঁদ ঠাকুরের এমনই একটি মহৎ কাজ। কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি 'মিলা'র সৎ কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হতো এই সমিতি। এর উদ্যেশ্য ছিল বহুমুখী। শিক্ষাবিস্তার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মজাপুকুর খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৎ উপায়ে জীবনধারণ করা, মানুষকে সাহায্য করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শাক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ 'লক্ষ্মীর গোলা' গঠন করেছিলেন। মরসুমের সময়ে ধান সংগ্রহ করে এ গোলায় রাখা হতো। দাম বাড়লে বিক্রি করে বিভিন্ন সামাজিক উপকরণ কেনা হতো। কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের সময় এই ধান গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হতো। আবার কখনো কখনো গোলার ধান ধারে দেওয়া হতো। তবে ফেরত দেয়ার সময় এক মণ ধানে ১০ সের বেশি দিতে হতো। এটা আসলে গ্রামীণ ব্যাংকিং পদ্ধতি ছিল। গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন বিচক্ষণ। তার চিন্তাচেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি স্বনির্ভরতা অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থ ছাড়া মুক্তি নেই।
১৮৫৮ সালে বাংলায় কৃষক বিদ্র্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এ সময় শক্তিশালী জমিদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও তাঁর নাম লেখা রয়েছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি। তারা এখনো নৌকায় চড়ে স্কুলে যায় শিক্ষালাভের জন্য। নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, যানবাহন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। এমনকি অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডা. সি এস মিড গুরুচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'সারা ভারতবর্ষের প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের মধ্যে তার মতো একজন দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন এবং অমিত তেজস্বী মানুষ আমি দেখিনি'। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু। তাঁর বংশধর ও অনুসারীরা এখনো দুই বাংলায় ছড়িয়ে আছেন এই সম্প্রদায়ের নয়নের মনি হিসেবে।
বর্তমান বাংলাদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৫০ লাখেরও বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা অবশ্যই কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশবিভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের একটা বড় অংশই মতুয়াদের সাথে আছেন, এটা বাস্তব। দুই বাংলার মতুয়াদের অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেত্রী হলেন বীণাপাণি দেবী ওরফে বড়মা। দেশ ভাগের অল্প আগে বাংলাদেশের ওড়াকান্দির বাড়ি ছেড়ে স্বামী ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে আসেন বড়মা বীণাপাণি দেবী। ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জন ঠাকুর অবিভক্ত বাংলায় ফরিদপুরের বিধায়ক ছিলেন। আবার পশ্চিমবঙ্গে বিধান রায়ের আমলে তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। কলকাতা থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠাকুরনগরের নামও তৈরি হয়েছিল তাঁর নামেই। ফলে একটা রাজনৈতিক আবহ এই পরিবারে আগে থেকেই ছিল। বড়মার মতো বাংলাদেশি মতুয়াদের নেত্রী ছিলেন মঞ্জুলিকা ঠাকুর ওরফে ছোটমা। ওড়াকান্দিতে ২০০৬ সালে ছোটমা মঞ্জুলিকা ঠাকুর মারা যান। তাঁর স্বামী ছিলেন ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বিধায়ক সচিপতি ঠাকুর। তাঁর পুত্র প্রভাসচন্দ্র ঠাকুর বর্তমানে বাংলাদেশ মতুয়া মহাসঙ্ঘের মহাসচিব। এর পুত্র সুব্রত ঠাকুর এখন কাশিয়ানী উপজেলার চেয়ারম্যান। ফলে বাংলাদেশেও মতুয়া পরিবারে একটি রাজনৈতিক আবহ আছে। এখনো প্রতিবছর মতুয়াদের উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে ৩০-৩৫ লাখ ও বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে প্রায় ১৫-২০ লাখ লোকের সমাগম হয়। মতুয়াদের রয়েছে শানবাঁধানো কামনা সাগর, যেখানে স্নান করলে নাকি পাপমুক্তি হয়। দুই বাংলা থেকে তো বটেই, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকেও আসেন প্রচুর তীর্থযাত্রী। বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লাঠির মাথায় বাঁধা ত্রিকোণ পতাকা, কাঁসর ও ডঙ্কা বাজনা বাজিয়ে মতুয়ারা নাচতে নাচতে 'হরি বলো' ধ্বনি দিতে দিতে সমবেত হয়। দিনে দিনে এই প্রবনতা বাড়ছে ছাড়া কমছে না।
মতুয়াদের নিয়ে চলচ্চিত্র, পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের দাবী অনুযায়ী স্কুল, কলেজ, গবেষণা কেন্দ্রের সুচনা হয়েছে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। আর এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকারের সাথে মতুয়াদের সম্পর্ক আরও ভালো। নতুন সরকারে মন্ত্রিপদে আছেন মতুয়া পরিবারের বড়মা'র ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। ফলে মতুয়াদের মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মতুয়া সাধারন মানুষের ভিতরে আছেন প্রচুর বামপন্থী সমর্থক। আছেন তাঁদের নেতৃত্বও। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়াদের সরাসরি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের ফলে সঙ্ঘাত ঘটছে। আগে এই সঙ্ঘাত ছিল ভিতরে, এখন ক্রমশঃ তা প্রকাশ্যে এসে গেল তাঁদের ২৫ তম সাধারন সভাকে কেন্দ্র করে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের অবিসংবাদী নেত্রী বড়মা বীণাপাণি দেবীর উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে, তাঁর দুই ছেলে রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ও সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর কার্যকরী সমিতি গঠনের জন্য আলাদা প্যানেল মাইকে ঘোষণা করলেন। তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন দুজনে। হতভম্ব বড়মা বীণাপাণি ঠাকুর দুইজনকে সামলাতে না পেরে অসহায় অবস্থায় সাধারন সভা বন্ধ করে দিলেন। এরপরে আরও নাটক জমে গেল। দেখা গেল দুই পক্ষের প্যানেলেই আছে বড়মার স্বাক্ষর। মন্ত্রীর প্যানেলে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ একঝাক রাজনৈতিক নেতার নাম। শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। প্রচুর মানুষ উভয় পক্ষের হয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। এদিকে এই সভায় কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি প্রাক্তন বিধায়ক বাম নেতা হরিপদ বিশ্বাসের অনুপস্থিতি নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পরে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর প্রতিপক্ষ ভাই রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে খুনের হুমকি দেবার অভিযোগ জানিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন।
আর এই প্রকাশ্য কলহ ভক্তকুলের কাছে হয়ে যায় যন্ত্রণা ও পীড়ার কারন। কার্যকরী সমিতির নদীয়া জেলার এক সদস্যের অভিযোগ, 'এই সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনে ইদানীং অতিরিক্ত রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের কারনেই এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রতি আগ্রহ হারাতে সাহায্য করবে'। এদিকে দু'জনেই দাবী করেছেন, তাঁদের প্যানেলই নির্বাচিত হয়েছে। বাস্তবে কি হয়েছে, তা একমাত্র বড়মা বীণাপাণি দেবীই জানেন। আপাততঃ তিনি মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। বিব্রত বড়মা কোন সাংবাদিকের সাথে দেখাও করেননি বা ফোনও ধরেননি। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগামিদিনে আরও বড় অশান্তির মেঘ দেখছে সাধারন মতুয়া ধর্মের ভক্তকুল।
বিজন গোলদার (পূর্ব প্রকাশের পর) দশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমরা বাঙলায় পাই অনুকূল ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬৯), রাম ঠাকুর (১৮৫৮-১৯৬৯), লোকনাথ বাবা (১৭৩১-১৮৯০), নির্মলা (পরিবর্তীত নামঃ আনন্দময়ী মা) (১৮৮৭-১৯৮২) এবং হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮) ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। এঁরা সকলেই বাঙলায় ধর্ম সংস্কারক ও জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ। তবে হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ব্যতীত অন্য সকলেরই শিষ্য ছিলেন ব্রাহ্মণ, মধ্যবর্ণ ও শূদ্র বর্ণগত মানুষেরা। গুরু শিষ্য পরস্পরায় ব্রাহ্মণ বা উচ্চ বর্ণজাত কোন হিন্দুর কাছে শূদ্র শিষ্যের স্বীকৃতি মেলে গুরুভাই পরিচয়ে। উচ্চ বর্ণের সন্তানেরা যতোটা সানি্নধ্য তারা দেয়, তারমধ্যেই তুষ্ট থাকে শূদ্ররা। এ সকল ধর্মগুরুদের মধ্য অনুকূল ঠাকুর ও আনন্দময়ী মা 'নারী মাত্র শূদ্র' এ চিন্তার আংশিক মৃত্যুতে ভূমিকা রাখেন। অনুকূল ঠাকুর নারীকে শিক্ষিত হতে বলেছেন আদর্শ জননী ও সুগৃহিণীর জন্য এবং সন্তানের মধ্যে তার প্রয়োগের কারণেই। তবে কর্মক্ষেত্রে তিনি নারীকে অনুপস্থিত রেখেছেন। আনন্দময়ী মা বলেন_ "যত্র জীব তত্র শিব যত্র নারী তত্র গোরী।" আর্য ব্রাহ্মণ সমাজ অনার্য দেবতা শিবকে লুটে নিয়ে শূদ্র ব্যতীত সকল জীবের মাঝে শিবের প্রতিষ্ঠা করে। শূদ্ররা অস্পৃশ্য জীবনবাহী মানুষ হয়েই সমাজে অবশিষ্ট থাকে। আনন্দময়ী মা হয়তো নারী বলেই ব্রাহ্মণ সমাজের 'শূদ্রাত্মা নারীকে' সৃষ্টিজননীর অংশরূপে গৌরীর মর্যাদা দেন। তবে এরা সকলেই ব্রাহ্মণ সমাজের রীতি নীতির মধ্যে নিজ নিজ ধর্মে আবদ্ধ থেকে কিছু লোক হিতকর পর্ব ও অনুসঙ্গ যোগে তাদের পথ ও মতকে চেষ্টা করেন মানবিক শরীরদানের। তবে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর মত ও পথে ভিন্নতার দাবিদার। হরিচাঁদের পূর্ব পুরুষ মৈথিলি ব্রাহ্মণ ও স্ত্রী শূদ্ররমনী। রক্তধারায় হরিচাঁদ অশূদ্র, যদিও শূদ্র সমাজে তিনি প্রচার পেলেন চৈতন্য অবতারে শূদ্ররূপে এবং গুরুচাঁদ শিবাবতারে। নতুন তীর্থ হলো ওড়াখান্দি এবং জন্ম নেয় মতুয়া সম্পদায়ের। শ্রীচৈতন্য অশাক্ত ও বৈষ্ণব তার ভাবান্দোলন ভক্তির প্রেম মাধুর্যে পূর্ণ ও শান্তরসের সমাধিস্থ নামভক্তি জোয়ারের জলের মতো ভাসিয়ে দেয় সমাজ, সংসার ও কলরব। তার সে প্রেমে ছিল শক্তির অনুপস্থিতি ও বৈষ্ণবীয়। কিন্তু শক্তিপূজা ও তান্ত্রিকধর্ম অনার্য বাঙালি চেতনায় আদি হতে এখনো ক্রিয়াশীল। মতুয়ার অবয়বে আধিক্য থাকে শক্তি ধর্মের। ওরা ঝা-া হাতে রনদামামার মতো ঢাকে আওয়াজ তোলে। সে নামে চৈতন্যের প্রভাব থাকে, তবে ভক্তিতে থাকে শক্তির তোজোময়তা, প্রকাশিত রুদ্রতেজে অন্তরাত্মা স্পর্শে তা থাকে অশিক্ত। তাই বহিরাঙ্গনের সজলতা ও কোমলতায় কতোটা হৃদয়াত্মা আশ্রিত; সমাজবীক্ষণে তা থাকে অপরীক্ষিত ও অনুত্তীর্ণ। তবুও তারা দক্ষিণ বাঙলার শূদ্রদের একত্রিত করে। ব্রাহ্মণ ও উচ্চ বর্ণের অংশগ্রহণহীনতায় এ পথের গ্রহণযোগ্যতা পায় অব্রাহ্মণ্য পথে শূদ্রধর্মে। তবুও এর অন্তরে এক ধরনের দ্রোহ থাকে। সে দ্রোহ চেতনাই অনুভবে আসে নেতাজীর। তিনি কোলকাতার অ্যালবার্ট হলে ১৯৩৮ সালের ১৩ মার্চ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অতিমানব বলায় শূদ্রবর্ণে নতুন প্রাণের সঞ্চারণে পুনর্জাগরিত হয় সে সমাজ।
এগারো বৃটিশ ভারতের ক্ষমতার শিরোমানতে তখন অধিষ্ঠিত বৃটিশ। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রভবনে থাকে অশূদ্র উচ্চবর্ণীয় ভারতবাসী। তাই বিবেকানন্দ ও সুভাষের প্রত্যাশার ছায়া পড়ে না শূদ্র সমাজে। বাঙলাও থাকে ভারতের উত্তর ও দক্ষিণের মতো শুষ্ক ও উদ্যানহীন। গান্ধীজির প্রার্থনা বাণীতে উচ্চারিক্ত হয়, "ঈশ্বর ঔর আল্লা তেঁরে নাম। সবকো সুমতি দে ভগবান।" তার অহিংসামন্ত্র গ্রাহ্যতা পায় সর্বজনে। তবে সে গ্রাহ্যতায় ফাঁক থাকে। বহুজনেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। অহিংসামন্ত্রে শূদ্রদেব তিনি সকলের সাথে এককরে গাঁথতে চাইলেন। তবুও ওরা "হরিজন" হয়ে পৃথক হলো। তার_ "রঘুপতিরাঘব রাজারাম পতিত পাবন সীতারাম।" প্রার্থনা সংগীতে আরাধ্য রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার যে বাসনা তিনি লালন করতেন, সে রাজ্যে শূদ্র শম্ভুকের অস্তিত্বহীনতার পরিণতির স্পষ্টতা সত্ত্বেও রামের প্রতি মোহাচ্ছন্নতায় তিনি ছিলেন অস্ফুট ও তমসাচ্ছন্ন। তাই শম্ভুক হত্যা তার গ্রাহ্যযোগ্য দৃষ্টিতে ছিল আগ্রাহ্য। অসুররূপী শূদ্র বধে তিনি শূদ্রের অস্তিত্বসন্ধানে অসমর্থ। তাইতো শূদ্র ও ব্রাহ্মণের সহবস্থান অনিশ্চিত থাকে সমাজে। বরং শূদ্র 'হরিজন' হয়ে পৃথক হয় এবং অহিংসামন্ত্রের ফাঁকফোকড় খুঁজে ব্রাহ্মণ সমাজের ত্রুরতা, শঠতা, নীচুতা, নির্মমতা ও অমানবিকতা গান্ধীজির সহজ, সরল এবং আড়ম্বরহীনতাকে করে প্রশ্রবিদ্ধ। বৃটিশ পরাধীন ভারতে ব্রাহ্মণ বর্ণীয় হিন্দু সমাজ রাষ্ট শাসনের কেন্দ্র ভূমিতে থেকে শাসন ও শোষণের অংশীদারিত্ব নেয়। ওরা ইংরেজ সংস্কৃতির কাছাকাছি আসে, কেউবা ওদের সাথে এক হতে চায়। আর যারা বৃটিশ শাসনাধিপত্য অবসানের লক্ষ্যে জোট বাঁধে, আন্দোলনে অংগীভূত হয়, সবই ঘটে শ্রেণী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রাহ্মণ উচ্চ বর্ণের ও অন্য ধর্মের শ্রেণী শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি ও সমষ্টির নেতৃত্বে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শূদ্র সমাজ থাকে উপেক্ষিত, শিক্ষা সংস্কৃতিতে তারা সর্বদাই থাকে দৃশ্যের অন্তরালে এবং রাষ্ট শক্তির অংশীদারিত্বে বা রাজশাসনের বিপক্ষে তারা তাদের অগোচরে দাঁড়ায়। তারা উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত ও বিচ্ছিন্ন থেকে বৃটিশ শাসনের রাজধর্ম গ্রহণে হয় আগ্রহী। ভারতে ১৯৩৬ সালে অনার্য অবশিষ্ট বিভিন্ন উপজাতির সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। তারা তখন সদলে খৃষ্টে অবলম্বন খোঁজে। অবলম্বনের প্রত্যাশায় থাকে বর্ণমুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। বাঙলায় সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা, চাকমা ও ছোট ছোট উপজাতির ধর্মান্তরের কারণের জায়গাগুলোতে থাকে একই ধরনের প্রত্যাশা। আম্বেদকার দলিত ও শূদ্র বর্ণভুক্ত মানুষ সম্পর্কে ব্রাহ্মণ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বলেন_ "মানবতার কারণে বর্বরদের সভ্য করার কোন চেষ্টাই হিন্দুরা করেনি শুধু নয়, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধা দিয়েছে হিন্দুদের আওতায় থাকা নিম্নবর্ণের মানুষদের, যাতে তারা উচ্চ বর্ণের সাংস্কৃতিক স্তরে উঠতে না পারে।" তিনি তাঁর আর একটি বক্তব্যে হিন্দু সমাজকে সচকিত করেন ও সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন_ "হিন্দুদের নৈতিকতায় জাতের প্রভাব নিরতিশয়ভাবে শোচনীয়। জাত জনশক্তিকে হত্যা করেছে। সাধারণ দয়া দাক্ষিণ্যকেও ধ্বংস করেছে। জাত জনমতকে অসম্ভব করে তুলেছে। জাতই হিন্দুর জনগণ। তার দায়-দায়িত্ব শুধু তার জাতহিন্দুর জনগণ। তার দায়দায়িত্ব শুধু তার জাতব্যবস্থার প্রতি। তার আনুগত্যই সেই জাতব্যবস্থার প্রতি। তার আনুগত্যই সেই জাতপাতে সীমাবদ্ধ। সদগুন জাতনির্ভর এবং তার নৈতিকতাও জাতপাতের সীমানায় ঘেরা। উপযুক্তের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই। পীড়িতের ডাকে কোন সাঙ্গড়া নেই। দয়া আছে, যার শুরু এবং শেষ জাতপাতে। সহানুভূতি আছে, কিন্তু ভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য নেই। একজন হিন্দু কি একজন মহান ও সজ্জন মানুষের নেতৃত্বে স্বীকার ও অনুসরণ করবে?" "হিন্দুরা বুঝতে পারেনি যে, এই সমস্ত আদিম উপজাতিরা সম্ভাব্য বিপদের উৎস। এই সমস্ত বর্বররা যদি বর্বর থেকে যায় তাহলে হিন্দুদের কোনও ক্ষতি নাও করতে পারে। কিন্তু অহিন্দুরা যদি এদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এবং তাদের ধর্মে দীক্ষিত করে তা হলে, তারা হিন্দুর শত্রুদের সংখ্যা স্ফীত করে তুলবে।" বৃটিশ ভারতে ইংরেজদের মাঝে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্কতা, চিন্তায় ও মননে প্রগতিশীলতায় আশ্রিত তাড়িত মানবমন ভারতের এ বর্ণবাদী বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন দেয় না, যদিও উচ্চবর্ণ ও উচ্চ শ্রেণীতে বসবাসরত ও রাজনীতির উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিতদের সাথে শাসন কার্যের সুবিধার্থে এক ধরনের আপোস ও সংহতি তারা রক্ষা করেই চলে। আবার চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ ও নিম্ন বর্গের মানুষেরা বেঁচে থাকার অধিকারটুকু অর্জনের জন্য বৃটিশদের অনুগ্রহ প্রার্থী হয়। ইংরেজরা কখনো মানবিকবোধে, কখনোবা রাষ্ট পরিচালনার সুবিধার্থে সংঘশক্তি ও বিভেদীকরণে মনুষ্যত্বের বিনাশকারী উচ্চ শ্রেণীর পক্ষ নেয় এবং এসব কারনেই বিশ শতকের শুরুতে মহাত্মার নেতৃত্ব্বে বৃটিশ বিরোধী যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, এতে দলিত ও নিম্নবর্ণভুক্ত মানুষদের সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং বর্ণ শাসন ও নিপীড়ন হতে কোন দিশার সন্ধান না থাকায় তা আম্বেদকর কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। সারা জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির দোলাচলে তার দ্রোহচেতনা সমাজ বিদ্রোহে মূর্ত হয় এবং ১৯২৭ সালে অস্পৃশ্য মানুষদের সাথে নিয়ে মনুস্মৃতিতে অগ্রিসংযোগে প্রকাশ পায় ব্রাত্য ও অন্ত্যজ সর্বহারা মানুষদের পুনর্জাগরণে অংশীভূত গণচেতনার বহির্প্রকাশ। জীবনময় দ্রোহী আম্বেদকর মৃত্যুর দু'বছর আগে প্রায় পাঁচ লক্ষ নিম্ন বর্ণের মানুষ নিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটাই ছিল তাঁর শেষ আঘাত। তাঁর এ নববৌদ্ধ বিদ্রোহী ধর্ম "নবযান" রূপান্তরিতভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি মাঝে থাকে অটুট বন্ধনে। আম্বেদকর ভারতের অন্যান্য অংশের মতো বাংলার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রাসংগিক। বর্ণবাদী চেতনার প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ভাঙ্গতে তার বিদ্রোহ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের মনজাগতিক পরিবর্তনে তার জ্ঞান, মনীষা, প্রজ্ঞা ও দর্শন বাঙালার নিম্ন বর্ণ ও নিম্ন বর্গের মানুষদের আত্মার মর্মবানীকে করে আন্দোলিত, উদ্দেলিত ও বিদ্রোহী। একারণেই তফশিলী ফেডারেশনের নেতা যোগেন ম-লের আমন্ত্রণেই ১৯৪৬ সালে আম্বেদকর অবিভক্ত বাংলার কোটা হতে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ক্রমশ...
হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার সফলাডাঙ্গা গ্রামে ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে।গুরুচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৪খ্রীষ্টাব্দেএবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৭খ্রীষ্টাব্দে।১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়,অর্থাৎ বাংলায় স্থায়ীভাবে জমিদারী শাসনের সূত্রপাত হয়।আর তার ১৯ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন হরিচাঁদ ঠাকুর।আর ভারত স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন গুরুচাঁদ ঠাকুর।এই সময়টাকে আমরা বিশেষ ভাবে খেয়ালে রাখব।ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এই যুগে ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের অত্যাচারে হিন্দুধর্মের যখন নাভিশ্বাস উঠছে,ব্রাক্ষ্মণদের অত্যাচারে হিন্দুরা জর্জরিত হচ্ছে এবং অনেক হিন্দুই ব্রাক্ষ্মণদের এই দুর্বিষহ অত্যাচার থেকে মুক্তি
২০
পাওয়ার জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে যাচ্ছে,এইরকম অবস্থায় হিন্দুদের এই ধর্মান্তরকরণ নতুন মাত্রা পেয়ে দ্রুত প্রসার লাভ করতে শুরু করল ব্রাক্ষ্মণ পন্ডিতদের ঘোষিত একটি বিধান দ্বারা।তারা ঘোষণা করল-"ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনং",অর্থাৎ ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যায়।এবং এই অজুহাত দেখিয়ে যেসব হিন্দু মুসলমানদের খাবার না খেয়েও তাদের খাবারের শুধু ঘ্রাণ নিয়েছে,ব্রাক্ষ্মণরা তাদেরও ধর্মচ্যূত করতে শুরু করে দিল।এই সময় সুফী মুসলমান ধর্মগুরু খাঞ্জালী মিঞা ব্রাক্ষ্মণদের এই বিধান জানতে পেরে এর সুযোগ নিল।-সে তার অনুগামীদের নিয়ে হিন্দু গ্রামের দক্ষিণ দিক বেছে নিয়ে গোমাংস সহযোগে পিকনিক করতে শুরু করে দিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল – দখিনা হাওয়ায় গোমাংসের ঘ্রাণ সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়া।যার ফলশ্রুতিতে ব্রাক্ষ্মণ্য বিধানের ফলে গ্রামকে গ্রাম হিন্দু মুসলমান হয়ে যেতে লাগল।ফলে একদিকে ব্রাক্ষ্মণ আর অন্যদিকে মুসলমান –এই দুইদিকের যাঁতাকলে পড়ে হিন্দুরা যখন বাংলায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল,ঠিক তেমনি এক সঙ্কটজনক সময়ে হিন্দু ধর্ম-সভ্যতা-সংস্কৃতির মুক্তিদূত হিসেবে আবির্ভূত হলেন হরিচাঁদ ঠাকুর।তিনি সমগ্র হিন্দু সমাজকে ব্রাক্ষ্মণ ও তাদের বিধান বর্জন করার ডাক দিলেন।তিনি বললেন,ব্রাক্ষ্মণ ও তার রচিত শাস্ত্র ও বিধান,জাতপাত হিন্দু ধর্মের দুশমন।হিন্দুদের শোষণ ও ধ্বংস করার জন্যই ব্রাক্ষ্মণরা এগুলো তৈরি করেছে।তিনি সমগ্র হিন্দু সমাজকে ব্রাক্ষ্মণ্য শাস্ত্র-বিধিবিধান-জাতপাত ত্যাগ করে একত্র হওয়ার ডাক দিলেন এবং সকলকে নিয়ে একত্রে পংক্তিভোজন করালেন -এই পংক্তিভোজনে সবাই যোগ দিলেন, এমনকি যেসব হিন্দু মুসলমান হয়েছিলেন তারাও। ফলে বৃহৎ হিন্দু সমাজ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হলো-সকল জাতপাতের বেড়া ভেঙ্গে ও ব্রাক্ষ্মণ্য-বিধানকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।তিনি ব্রাক্ষ্মণ ও ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মকে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন এবং ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রভুত্ব ও আধিপত্যকামীতা থেকে হিন্দুদেরকে মুক্ত করলেন এবং এদেরকে ব্রাক্ষ্মণদের থেকে আলাদা বলে ঘোষণা করলেন-
"কোথায় ব্রাক্ষ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভন্ড সব।।
স্বার্থশূন্য নামে মত্ত মতুয়ার গণ।
২১
ভিন্ন সম্প্রদায়রূপে হইবে কীর্তন"।।
এইভাবে ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়রূপে মতুয়া ধর্মের উদ্ভব ঘটল- ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে।কিন্তু ব্রাক্ষ্মণরা এসব হজম করতে পারল না-কারণ তার ফলে হিন্দুদের উপর তাদের যুগ যুগ ধরে প্রভুত্বের অবসান ঘটল।তাই তারা হরিচাঁদ ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়লো-
"বেদ বিধি নাহি মানে না মানে ব্রাক্ষ্মণ।
নিশ্চয় করিতে হবে এ দলের শাসন"।।
শুধু হুঙ্কার ছেড়েই থামল না-হরিচাঁদ ঠাকুরকে এরা ষড়যন্ত্র করে ভিটেছাড়া করল।তখন নিজ গ্রাম ত্যাগ করে তিনি পাশের গ্রাম ওড়াকান্দিতে এসে আশ্রয় নিলেন।এই ওড়কান্দিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে মতুয়া আন্দোলন ছড়িয়ে দিলেন সমগ্র বাংলায়।এইভাবে তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন এবং ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন।
যাই হোক,হরিচাঁদ ঠাকুরের পর মতুয়া আন্দোলনের হাল ধরলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর।তাঁর নেতৃত্বে মতুয়া আন্দোলন আরো ব্যাপকতা লাভ করে।তিনি শুধু ধর্ম নয়-রাজনৈতিক,সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক চেতনা ও আন্দোলন গড়ে তুললেন,যা ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।
মতুয়াদের তিনি রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে চাইলেন এবং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার আদর্শে অনুপ্রাণিত করলেন।তিনি বললেন-
"যে জাতির রাজা নেই।
সে জাতি তাজা নেই"।।
তিনি আরো বললেন-
২২
"রাজশক্তি মূল শক্তি কহিনু নিশ্চয়।
রাজশক্তি বিনা কেহ বড় নাহি হয়"।।
তাই তিনি দাসত্বের মানসিকতা ত্যাগ করে রাজকীয় মানসিকতা গড়ে তুলতে বলেছেন-
"রাজা যদি হতে চাও ধর রাজভাব।
ভাব অনুযায়ী আসে ভাবের স্বভাব"।।
তিনি আরো বলেছেন-
"জাতি ধর্ম যাহা কিছু উঠাইতে চাও।
রাজশক্তি থাকে হাতে যাহা চাও পাও"।।
আর এই রাজশক্তি দখল করার জন্য তিনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দল গড়ার কথা বললেন।তিনি বললেন-
"যে জাতির দল নেই।
সে জাতির বল নেই"।।
তাঁর জীবৎকালে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সাফল্যও পেয়েছিলেন।এই সাফল্যের পথ ধরে পরবর্তীকালে যোগেন মন্ডলের হাত ধরে আম্বেদকর গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।ফলে আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পান – যার ফলশ্রুতিতে আজ তামাম ভারতবর্ষের দলিত-নিপীড়িত-শোষিত জনতা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে।
যাই হোক,এবার সংক্ষেপে তাঁর শিক্ষা আন্দোলনের কথা কিছু বলি।তাঁর এই শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি সুবৃহৎ আন্দোলন।গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুগামীদের সহযোগীতায় বাংলাদেশে দু'হাজারের উপর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তাঁর সাথে কেউ দেখা করতে এলে তিনি প্রথমেই তাকে একটি কথা জিজ্ঞেস
২৩
করতেন যে,তার গ্রামে বিদ্যালয় আছে কিনা।সে যদি বলতো-নেই,তাহলে তিনি বলতেন- আগে তোমার গ্রামে বিদ্যালয় তৈরির ব্যবস্থা করো,তারপর আমার সাথে দেখা করতে এসো।এটা ছিলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।তিনি বলতেন-
"খাও বা না খাও।
ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দাও"।।
তাঁর শিক্ষামূলক আরো কয়েকটি বাণী নিচে সন্নিবেশিত করা হল-
তিনি কান্দাকান্দি ক'রে ধূলো কাদায় গড়াগড়ি করার পরিবর্তে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলেছেন-"স্নানদানে শৌচাচারে সুসভ্য হইবে।
অপবিত্রভাবে কেহ কভু না চলিবে"।।
হরিচাঁদ ঠাকুরও বলেছেন-
"দেহমন সর্বক্ষণ রাখিবে পবিত্র।
শিখাইতে হবে জীবে এই মূল সূত্র"।।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ধর্ম বলতে মানব ধর্মকেই বুঝিয়েছেন,কোন আচার-বিচার ছুৎমার্গকে নয়। তিনি বলেছেন-"নাহি চিনি দেবদেবী।
ঘট পট কিবা ছবি"।।
বরং তিনি ঘরসংসার-পরিবারকে শান্তিতে, সুন্দর ক'রে গড়ে তোলার কথা বলেছেন,পারিবারিক উন্নতির জন্য গৃহধর্ম পালনের কথা বলেছেন-
"গৃহধর্ম গৃহকর্ম করিবে সকল।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল"।।
২৫
পৃথিবীতে ধর্মের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ভাবনা।জগতের সকল মানুষ পরিবারে আবদ্ধ।তাই প্রতিটি পরিবারের কল্যাণের মধ্য দিয়েই কেবল জগতের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হতে পারে,নচেৎ নয়।
আর ঈশ্বর বলতে আকাশে বসে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন,এমন কোন মহাপিতার কথা বোঝেননি। ঈশ্বর বলতে তিনি বুঝেছেন-
অংশ অবতার যত পূব্বেতে আইলো, আমি পূন জানি তারা সকলি জুটিল ।। রাম,কৃষ্ণ,বৌদ্ধ আদি অথবা গৌরাঙ্গ , আমাকে সাধনা করে পেতে মম সঙ্গ ।। পূ্ন আমি সব্বময় অপুর্নের পিতা , সাধনা আমার কন্যা আমি জন্মদাতা ।। আমি হরিচাঁদ এবে পূর্নের অবতার , অজর অমর আমি ক্ষীরোদ ঈশ্বর ।।
পাদটীকা
পূর্ণব্রহ্ম ও যুগাবতার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর (ইংরেজি: Harichad Thakur)(বাংলা ফাল্গুন১২১৮ - ২৩শে ফাল্গুন, ১২৮৪)মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক। বাংলাদেশের বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলারওঢ়াকাঁন্দির পার্শ্ববর্তী সাফলিডাঙ্গা গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ঠাকুরেরে মাতা-পিতার নাম অন্নপূর্ণা ও যশোমন- ঠাকুর। তার জীবনী কালে তিনি অসংখ্য লীলা করে গেছেন। প্রচার করেছেন মতুয়া ধর্ম। মতুয়া অর্থ, নামে যে মাতুয়ারা। ঠাকুর বলেছেন বাড়িতে হরি মন্দির প্রতিষ্ঠা কর এবং শুধু হরি নাম কর। অন্য কিছুর দরকার নাই, দরকার শুধু মানুষেতে নিষ্ঠা। কলি যুগে হরিনাম বিনে কোন গতি নাই। শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দুই ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর ও উমাচরন। এদের মধে গুরুচাঁদ ঠাকুর অন্যতম। গুরুচাঁদ ঠাকুর ঐ সময়কার ফরিদপুর জেলার খৃষ্টীয় মিশনারীর রাজ-পুরোহিত ডঃ সি, এস, মীড এর সহায়তা নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বলেছেন সর্বাগ্রে শিক্ষা গ্রহণ কর। শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী নিয়ে শ্রীমৎ রসরাজ তারক সরকার লিখে গেছেন " শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত"। হরিলীলামৃত স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন- উৎস। সর্বোচ্চ সত্য লাভের সুগম পথ হরিলীলামৃতে প্রদর্শিত।
No comments:
Post a Comment