Wednesday, June 19, 2013

প্রতিবাদী মহাকরণ, মুখর হবে রাজপথ

প্রতিবাদী মহাকরণ, মুখর হবে রাজপথ
মহাকরণে দলমত নির্বিশেষে বিক্ষোভে কয়েকশো সরকারি কর্মী।----শম্ভু জানা।
প্রতিবাদী মহাকরণ, মুখর হবে রাজপথ

এই সময়: অপরাজিতাকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় কামদুনি থেকে কলকাতা, সাধারণ মানুষ আগেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন৷ বিক্ষিপ্তভাবে তাতে গলা মিলিয়েছিলেন লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একাংশ৷ প্রতিবাদে অবিচল কামদুনিও৷ মঙ্গলবারও সেখানে পুলিশ-প্রশাসন এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ গ্রামবাসীরা৷ তৃণমূলের হুমকি-চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এদিন পথে নামে স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা৷ কলকাতায় একাধিক মহিলা সংগঠনের মঞ্চ 'মৈত্রী'র ডাকে প্রতিবাদী পদযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষিতা মহিলাও৷ রাজপথের সেই প্রতিবাদকে এ বার আরও জোরালো এবং সংগঠিত রূপ দিতে এগিয়ে এলেন শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, সৌমিত্র চ‌েাপাধ্যায়, মৃণাল সেন, মহাশ্বেতা দেবী, তরুণ মজুমদার, তরুণ সান্যাল, সব্যসাচী চক্রবর্তীর মতো মানুষেরা৷ ২১ জুন, শুক্রবার কলকাতায় প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলের ডাক দিয়েছেন তাঁরা৷ ওইদিন বিকেল ৩টেয় কলেজ স্কোয়ার থেকে ওই মিছিল শুরু হবে৷ শেষ হবে ধর্মতলায়৷

নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং সিপিএমের হামলাবাজির প্রতিবাদে ২০০৭-এর ১৪ নভেম্বর কলকাতায় মহামিছিলের ডাক দিয়েছিলেন সুশীল সমাজের বড় অংশ৷ সেদিনের মিছিলে যাঁদের প্রথম সারিতে হাঁটতে দেখা গিয়েছিল, ঘটনাচক্রে তাঁদের অনেকেই এ বারের মিছিলেরও উদ্যোক্তা৷ তবে সেই মিছিল হয়েছিল তিন দশক ক্ষমতাসীন একটি সরকার তথা শাসক দলের বিরুদ্ধে৷ ২১-এর মিছিল হতে চলেছে এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে যার বয়স মাত্র দুই৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সবচেয়ে অস্বস্তির হল, সুশীল সমাজের যে অংশ রাজনৈতিক পালা বদলে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, গত দু'বছরের নানা ঘটনায় তাঁরা সরকারের সমালোচনায় মুখর হলেও এভাবে পথে নামার কথা বলেননি৷ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আর দিন পনেরোও বাকি নেই৷ এই সময় সরকার বিরোধী এই মহামিছিলের উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলেছে শাসক দল, তেমনই বিরোধীরা বেজায় খুশি৷ উদ্যোক্তারা অবশ্য বলেছেন, কোনও দল-সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের এই প্রতিবাদ নয়৷ যদিও তাঁদের বিবৃতিতে স্পষ্ট, সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকেও এমন প্রতিবাদের ডাক, যাতে বলা হয়েছে, দুষ্কতকারীদের আচরণ দেখে মনে হয় তারা ধরেই নিয়েছে তাদের শাসন করবার কেউ নেই, যে কোনও কুকীর্তির-ই অধিকার আছে তাদের৷

২১ তারিখের মিছিলকেও মহামিছিলের রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ শঙ্খবাবুরা ওইদিন দলমত নির্বিশেষে সকলকে প্রতিবাদে পা মেলাতে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আহ্বান জানিয়েছেন৷ দুপুরে এই কর্মসূচির কথা জানাজানি হতেই এক প্রকার গর্জে ওঠেন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা৷ তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন তাঁরা মিছিলের উদ্যোক্তাদের৷ সোমবার কামদুনির প্রতিবাদী মানুষকে সিপিএম বলে গালমন্দ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এদিন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, 'দলীয় সূত্রে জেনেছি, কামদুনিতে মাওবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷' প্রসঙ্গত, নন্দীগ্রামের আন্দোলনকেও একসময় মাওবাদীদের ষড়যন্ত্র বলে চালাত বিগত বামফ্রন্ট সরকার এবং সিপিএম৷

এদিনই খোদ মহাকরণে কামদুনি নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন সরকারি কর্মচারীদের একাংশ৷ মহাকরণ কর্মীবৃন্দ নামে কর্মচারীদের একাধিক সংগঠনের তরফে সোমবারই এক মঞ্চ গড়ে রাইটার্স বিল্ডিংসের অভ্যন্তরে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ ছ'বছর আগে নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদেও কর্মচারীদের একাংশ কাজ ফেলে এভাবেই প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছিলেন৷ এদিন মহাকরণের চারতলায় জি ব্লক থেকে বেলা ১টার পর পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে শ'চারেক কর্মচারী কামদুনিসহ রাজ্যের নানা প্রান্তে মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে গোটা রাইটার্স পরিক্রমা করেন৷ প্রশাসন এই ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্রিয় নয় বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা৷ মিছিল শেষে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে চান৷ এনিয়ে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের প্রায় ঘণ্টা চারেক টানাপোড়েন চলে৷ শেষ পর্যন্ত স্মারকলিপি না দিয়েই যে যার ঘরে ফিরে যান কর্মচারীরা৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু'বছরের জমানায় খোদ মহাকরণে এমন প্রতিবাদ শুধু নজিরবিহীনই নয়, মহার্ঘ্যভাতা, বেতন বৃদ্ধির মতো দাবিতে এমন সংগঠিত মিছিল আগে দেখা যায়নি৷

কামদুনির ঘটনার দু'দিনের মাথায় কবি শঙ্খ ঘোষ 'এই সময়'-এ লিখেছিলেন, কামদুনির উদ্দীপ্ত প্রতিবাদই আলোর শিখা৷ আরও লিখেছিলেন, যে প্রতিবাদী মানুষেরা ক্ষতিপূরণের সরকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের প্রতি আমার প্রণতি রইল৷ সেই বিবৃতি উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সেদিনই শঙ্খবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে মহামিছিলের প্রাথমিক আলোচনা সেরে রেখেছিলেন৷ তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই কামদুনি গিয়ে অপরাজিতার পরিবারকে বলে আসেন, প্রতিবাদ থামবে না৷

এদিন শঙ্খবাবু-নবনীতাদেবীরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, কেন তাঁরা ২১-এর মিছিলে পা মেলাতে আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাতে বলা হয়েছে, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই চলছে বেপরোয়া নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ আর হত্যার তাণ্ডব৷ দুষ্কতীদের আচরণ দেখে মনে হয় তারা ধরেই নিয়েছে তাদের শাসন করার কেউ নেই, যে কোনও কুকীর্তির-ই অধিকার আছে তাদের৷ অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হয়ে উঠছে এক আতঙ্কের আবহ৷ প্রশাসন যদি এখনও এর প্রতিবিধানের জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে না পারে, গোটা রাজ্যজুড়ে তাহলে দেখা দেবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়৷ শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাই নয়, আমরা এ-ও মনে করি যে চারদিকের এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের গড়ে তুলতে হবে প্রবল এবং সংগঠিত সামাজিক প্রতিরোধ৷ সমস্ত রকম বিভেদ ভুলে সবাইকে একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে আজ, দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে স্বতঃস্ফর্ত যে প্রতিবাদের পথ দেখিয়েছেন কামদুনিরই সাধারণ মানুষজন৷

No comments:

Post a Comment