Sunday, June 16, 2013

স্বপ্ন উড়ানে শহরে পা দিলেন খবরের ফেরিওয়ালা শিবকুমার

স্বপ্ন উড়ানে শহরে পা দিলেন খবরের ফেরিওয়ালা শিবকুমার

স্বপ্ন উড়ানে শহরে পা দিলেন খবরের ফেরিওয়ালা শিবকুমার
নতুন যাত্রার শুরু। প্রেরণার নাম শিবকুমার।---কুমারশঙ্কর রায়।
মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত ও কুমারশঙ্কর রায়

নিজের ছবি ছাপা কাগজটা যেদিন লোকের বাড়ির বারান্দায় ছুড়ে দিয়েছিলেন, সেদিন শিহরিত হয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর ২৩ বছরের হকার এন শিবকুমার৷ ছবি ছাপার কারণ, দরিদ্র হকার পা রাখছেন আইআইএম জোকায়৷ পরের দিন আবার কাগজ দিতে গেলে বহু লোক তাঁকে ডেকে চা খাইয়েছিলেন৷

শনিবার বেঙ্গালুরু ছাড়ার আগেও বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করলেন শিবকুমার! আইআইএম কলকাতায় পড়ার ছাড়পত্রও বদলাতে পারেনি তাঁর সহজ-সরল জীবনযাত্রা৷ শনিবার বিকেলে বিমানে চেপে প্রথমবার বেঙ্গালুরু ছাড়ার দিনও ভোর চারটের সময় খবরের কাগজের বান্ডিল নিয়ে ছুটলেন এই বাড়ি থেকে সেই বাড়ি৷ আর সন্ধ্যায় দমদম বিমানবন্দরে পা রেখে 'এই সময়'কে একান্ত সাক্ষাত্‌কারে তিনি বললেন, 'নিজের জীবনই সব থেকে বড় শিক্ষক৷ অনেক কিছু শিখেছি জীবন থেকে৷'

কিন্ত্ত আপনি আজকেও খবরের কাগজ ফেরি করলেন?

'কেন করব না৷ শিকড়কে অস্বীকার করতে নেই কখনও৷ খবরের কাগজ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে৷ কাগজ বিলি করার আগেই পড়ে নিতাম সব কাগজ৷ পরে ক্যাট পরীক্ষায় সেটা আমার খুব কাজে দিয়েছিল৷ সেই দিনগুলি অস্বীকার করা অন্যায়৷' মুচকি হেসে বললেন শিবকুমার৷ তার পর 'এই সময়'-এর গাড়ি চেপে রওনা দিলেন হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশে৷ রাতেই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে তিনি যাবেন ভাগলপুরে৷ সেখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি শোনাবেন তাঁর জীবনের লড়াইয়ের কথা৷ কী ভাবে দারিদ্র উপেক্ষা করে তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলেন৷ কী ভাবে সকালে খবরের কাগজ বিক্রি করে রাত জেগে পড়াশুনা করতেন৷

রোগাপাতলা চেহারা৷ চুল ছোট ছোট করে কাটা৷ তবে চোখ দু'টি জ্বল জ্বল করছে৷ কথায় কথায় বললেন, 'ক্লাস ফোর থেকে খবরের কাগজ বিক্রি করি৷ সকাল চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে ছুটতাম৷ তার পর সেখান থেকে স্কুল৷ প্রতিদিন আমার স্কুল পৌঁছতে দেরি হয়ে যেত৷ লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসতাম৷' হেসে বললেন, 'আমি কিন্ত্ত ব্যাক বেঞ্চার্স! শুধু তাই নয়, লাস্ট বেঞ্চে বসে আমি নিয়মিত ঘুমিয়ে পড়তাম৷ মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকাও খেতাম৷ তবে লাস্ট বেঞ্চের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে আমার একটা ছোট্ট পার্থক্য ছিল৷ আমি সব পরীক্ষায় প্রথম হতাম৷ স্কুল জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হইনি৷'

দমদম বিমানবন্দর থেকে গাড়ি উল্টোডাঙ্গার কাছাকাছি আসতেই কিছুটা উত্তেজিত দেখাল তাঁকে৷ বললেন, 'আমার একটা অনুরোধ আছে৷ হাওড়া ব্রিজ এলে আমাকে একটু বলবেন৷ ছোটবেলা থেকেই আমার হাওড়া ব্রিজ দেখার খুব ইচ্ছে৷ সিনেমায় দেখেছি৷ কিন্ত্ত নিজের চোখে কখনও দেখিনি৷ আমি তো কখনও বেঙ্গালুরুর বাইরে যাইনি৷'

আর কলকাতায় এসে কেমন লাগছে?

'খুব ব্যস্ত শহর মনে হচ্ছে৷ এত মানুষ চারদিকে৷ তবে কলকাতা বলতে আমার কাছে, হাওড়া ব্রিজ, কেকেআর এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়৷ আর হ্যাঁ, আইআইএম জোকা৷' হাসতে হাসতে বললেন শিবকুমার৷

প্রিয় চরিত্র?

কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, 'আমার মা-বাবা-কাকা এঁরা সবাই আমার খুব প্রিয় চরিত্র৷ তবে শাহরুখ আর সচিনও আমার খুব প্রিয় চরিত্র৷ তাঁরা ভালো অভিনেতা বা ক্রিকেটার বলেই শুধু নয়, দুজনের সঙ্গে আমি দেখা করেছি৷ জীবনে এত সফল হয়েও তাঁরা এত সাধারণ জীবন-যাপন করেন৷ এটাই আমাকে টানে৷ আসলে জীবনে সফল হওয়ার গুপ্তিমন্ত্রটা আমার মতে, মাটির কাছাকাছি থাকা৷ সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকা৷ এটা খুব জরুরি৷ এই যে, আজ আমাকে বেঙ্গলুরু বিমানবন্দরে ছাড়ার জন্য তিন গাড়ি মানুষ এসেছিল৷ এঁরা কেউ আমার আত্মীয়, কেউ আমার বন্ধু৷ এঁদের ভালোবাসা আমি উপেক্ষা করব কীভাবে?' তাঁর সাফ কথা, আইআইএম কলকাতায় পড়তে এসেছি শুধু মোটা বেতনের চাকরির জন্যই নয়৷ বেশি টাকা রোজগার করতে চাই এই কারণে, যাতে ভবিষ্যতে আমি সাহায্য করতে পারি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও অনেক শিবকুমারকে৷

এটাই তো হাওড়া ব্রিজ৷ টিভিতে দেখেছি তো! আর কোনও প্রশ্ন নয়৷ হাওড়া ব্রিজের সামনে আমার একটা ছবি তুলে দেবেন প্লিজ!

No comments:

Post a Comment