Sunday, May 15, 2011

মতুয়াদের মন জয়ের মরিয়া প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাবের কথা বিবেচনা করেই। এবং এখানেই ‘আশঙ্কা’ দেখতে পাচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিকেরা। তাঁদের কথায়, এ রাজ্যে এখন সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা মূলত ব্রাহ্মণ, বৈদ্য

 মতুয়াদের মন জয়ের মরিয়া প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাবের কথা বিবেচনা করেই। এবং এখানেই 'আশঙ্কা' দেখতে পাচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিকেরা। তাঁদের কথায়, এ রাজ্যে এখন সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা মূলত ব্রাহ্মণ, বৈদ্য বা কায়স্থ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি চেপে বসলে তফসিলিরা তো বটেই, আগুরি, মাহিষ্য বা সদগোপেরা (যার মধ্যে পড়ে কৈবর্ত্য) নিজেদের প্রতিনিধিত্বের দাবি জানাতেই পারেন! বামফ্রন্টের এক প্রবীণ নেতার কথায়, "ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ মিলে রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ১৬-১৭%-এর বেশি হবে না। সে দিক থেকে ধরলে আগুরি, মাহিষ্য, সদগোপ মিলে দাবি করলে মুখ্যমন্ত্রী-সহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদ ওঁদেরই প্রাপ্য!" প্রসঙ্গত, তাঁরা জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ আমলে মাহিষ্যেরা তফসিলের অন্তর্ভুক্তই ছিলেন। বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মামলা করে তাঁরা তফসিলের বাইরে বেরিয়ে আসেন।


'বর্ণ-বাঘে' সওয়ার হয়ে বঙ্গে জন্ম ভিন্ন রাজনীতির

সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা

 বারের বিধানসভা নির্বাচন চিহ্নিত ক্ষমতার 'পরিবর্তনের' জন্য। কিন্তু মহাকরণে পালাবদলের পাশাপাশিই বাংলার রাজনীতি অন্য এক 'পরিবর্তন' দেখে ফেলেছে! উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের নানা রাজ্যের মতো বঙ্গভূমিতেও জন্ম নিয়েছে বর্ণ-জাত-সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী পরিচয়ের রাজনীতি (আইডেন্টিটি পলিটিক্স)! এতটাই, যে শাসক ও বিরোধী শিবিরের প্রতিযোগিতার সেই রাজনীতি আগামী দিনে রাজ্যের 'নিয়ন্ত্রক' হয়ে উঠবে, এমন সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।

এই 'পরিবর্তনের' সূচনা বিধানসভা ভোটের ফয়সালা হওয়ার আগে থেকেই। মতুয়া-মন পেতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপাণি দেবীর (বড়মা) ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রার্থী করা, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চাঁদপাড়ায় ছুটে গিয়ে মতুয়া-গুরু হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে কলেজের শিলান্যাস বা তাঁদের নামে পুরস্কার চালু করা— এই সব ঘটনাই গোষ্ঠী-ভিত্তিক রাজনীতির সূচক। জনসাধারণের কোনও অংশের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা দূর করার উদ্যোগকে ছাপিয়ে যেখানে গোষ্ঠী-আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রয়াসই বড় হয়ে উঠেছে। এই ধারা চালু থাকলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আবেগ-নির্ভর রাজনীতিই যে সামনে চলে আসবে এবং তখন তার জেরে অশান্তির আশঙ্কার কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না যুযুধান দুই শিবিরই। এমনিতেই এ রাজ্যে মধ্যমেধার জয়জয়কার। এর পরে 'মেধা' বা 'যোগ্যতা'কে আরও পিছনে ঠেলে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগত পরিচয়ই প্রধান মাপকাঠি হয়ে ওঠারও সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে!

২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ২৩.২% তফসিলি জাতি এবং ৫.৫% তফসিলি উপজাতিভুক্ত। ১০ বছর পরের জনগণনা অনুযায়ী যা অবধারিত ভাবেই বাড়বে। তা ছাড়াও এখন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) আওতায় ১০৮টি গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে আবার ৫৩টি মুসলিম।

মতুয়া-মন পেতে তৃণমূল নেত্রী গাইঘাটা আসনে প্রার্থী করেছিলেন বড়মার ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণকে। তিনি প্রায় ২৫ হাজার ভোটে জিতেছেন। শুধু তা-ই নয়, বনগাঁ মহকুমার সব ক'টি আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। প্রতিটি আসনেই জয়ের গড় ব্যবধান ২০ হাজার বা তার বেশি। ভোটের আগে ওই এলাকার যে তৃণমূল প্রার্থীরা ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বড়মার 'আশীর্বাদ' নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই জিতেছেন। এমনকী, পাশের যে জেলায় মতুয়াদের কিছু প্রভাব আছে, সেই নদিয়াতেও সব আসন গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। মতুয়া-রাজনীতির হাত ধরেই এ রাজ্যে 'আইডেন্টিটি পলিটিক্স'-এর উত্থান সব চেয়ে বেশি।

বস্তুত, মতুয়াদের মন জয়ের মরিয়া প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাবের কথা বিবেচনা করেই। এবং এখানেই 'আশঙ্কা' দেখতে পাচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিকেরা। তাঁদের কথায়, এ রাজ্যে এখন সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা মূলত ব্রাহ্মণ, বৈদ্য বা কায়স্থ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি চেপে বসলে তফসিলিরা তো বটেই, আগুরি, মাহিষ্য বা সদগোপেরা (যার মধ্যে পড়ে কৈবর্ত্য) নিজেদের প্রতিনিধিত্বের দাবি জানাতেই পারেন! বামফ্রন্টের এক প্রবীণ নেতার কথায়, "ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ মিলে রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ১৬-১৭%-এর বেশি হবে না। সে দিক থেকে ধরলে আগুরি, মাহিষ্য, সদগোপ মিলে দাবি করলে মুখ্যমন্ত্রী-সহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদ ওঁদেরই প্রাপ্য!" প্রসঙ্গত, তাঁরা জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ আমলে মাহিষ্যেরা তফসিলের অন্তর্ভুক্তই ছিলেন। বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মামলা করে তাঁরা তফসিলের বাইরে বেরিয়ে আসেন।

গোষ্ঠী-নির্ভর রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতার সূচনা গত পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটে বামেদের তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে ধস নামার পর। তফসিলি জনসমর্থনের ভিত আরও সংহত করতে মতুয়াদের ঢেলে 'উপহার' দিতে শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। মতুয়া মহাসঙ্ঘের 'উন্নয়ন কল্পে' মমতা এবং তাঁর দলের সাংসদ-বিধায়কেরা টাকা দিচ্ছেন, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নামে রেলের স্টেডিয়াম, টেকনিক্যাল কলেজ হচ্ছে। এই তৎপরতার কারণ রাজ্যের প্রায় ৮৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়াদের কম-বেশি উপস্থিতি এবং তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাব। মমতাকে 'এগিয়ে' যেতে দেখে তফসিলি ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন আটকাতে মরিয়া হয়েছিল সিপিএম তথা রাজ্য সরকারও। মতুয়াদের জন্য কলেজ বা তাঁদের নামে পুরস্কারের পাশাপাশি তাঁদের নাগরিকত্বের অধিকারের দাবিতেও সরব হতে দেখা গিয়েছে সিপিএম-কে। ভোটব্যাঙ্কের টানেই নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে মতুয়া সমাবেশে এক মঞ্চে সিপিএম-তৃণমূলের যৌথ উপস্থিতির বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছে রাজ্য রাজনীতি!

প্রধান বিরোধী নেত্রী থেকে ক্ষমতায় পৌঁছনোর সিঁড়িতে চড়তে মমতা না-হয় বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর আবেগকে 'হাতিয়ার' করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জাত-বর্ণ-ধর্মের রাজনীতিতে অবিশ্বাসী সিপিএম কেন সেই দৌড়ে সামিল? দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, "মমতা বা সিপিএম বলে নয়, সারা বিশ্বেই এখন রাজনৈতিক ভাবে মানুষকে সংগঠিত করার উপাদান হিসাবে ধর্মীয়, জাতিগত বা সামাজিক পরিচিতি ব্যবহারের চল শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর অনুন্নয়নের সমস্যা দূর করার চেষ্টা বা গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের বক্তব্য শোনার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু আগে যেটা আশা-আকাঙ্ক্ষার (অ্যাস্পিরেশন) রাজনীতি ছিল, সেটাই এখন চাপিয়ে দেওয়ার জায়গায় (অ্যাসারশন) চলে যাচ্ছে। সেটা বিপজ্জনক।" সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং তফসিলি সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস আরও ব্যাখ্যা করে বলছেন, "মতুয়াদের হরিচাঁদ ঠাকুর অবিভক্ত বাংলায় ৩৬টি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষা প্রসার এবং সামাজিক সংস্কারে তাঁদের বড় ভূমিকা ছিল। মতুয়া বা ওই ধরনের কোনও সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতা দূর করার চেষ্টার মধ্যে জাতপাতের রাজনীতি নেই। কিন্তু এটাকে রাজনীতির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করলে বিপদ আছে।" প্রসঙ্গত, বর্ণ-জাত-ধর্ম নির্বিশেষে পশ্চাৎপদতা এবং বৈষম্য দূর করার জন্য সমবেত হওয়া মতুয়াদের ঘোষিত উদ্দেশ্য হলেও তাঁদের মধ্যে ৮০% নমঃশূদ্রের উপস্থিতিই যে তাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির টানাটানির কারণ, সে ব্যাপারে বিশেষ দ্বিমত অবশ্য নেই।

ঘটনা হল, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতা দূর করার কথা-বলা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বা কেন্দ্রীয় কমিটির মতো 'ক্ষমতাসম্পন্ন' কমিটিগুলিতে তথাকথিত 'অনগ্রসর'দের কোনও প্রতিনিধি নেই। সেলিমের ব্যাখ্যায়, "যে কোনও কমিউনিস্ট পার্টিই লেনিনবাদী নীতিতে সংগঠন চালায়। শাখা থেকে শুরু করে সংগঠনের সমস্ত স্তরে নানা জাতিসত্তা বা ভাষাগোষ্ঠীর লোকজনকে সামিল করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নেতৃত্ব স্তরে তাঁদের তো বসিয়ে দেওয়া যায় না! সেটা নির্ভর করে আন্দোলনের কোন স্তর তাঁরা পেরিয়ে আসছেন তার উপর।" অদূর ভবিষ্যতে মমতা তাঁর দলকে কী ভাবে সাজান, যে সব সম্প্রদায়ের 'উন্নয়নের' কথা তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, প্রশাসন বা সংগঠনে তাদের প্রতিনিধিদের রাখেন কি না, সেই উত্তর দেবে ভবিষ্যতই।

তৃণমূলের তরফে মতুয়াদের সঙ্গে 'সেতুবন্ধনের' মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রশ্ন, "মতুয়া-অবদানের কথা বুঝতে সিপিএমের ৩৪ বছর লেগেছে! সেখানেই তো রাজনীতি!" কান্তিবাবু মানছেন, "কেন ৩৪ বছর লাগল, সে প্রশ্নের সত্যিই কোনও জবাব নেই!" বিলম্বে বোধোদয় যেমন সিপিএমের 'অস্বস্তি'র কারণ, তেমনই মতুয়া নিয়ে 'বাড়াবাড়ি'তেও দলের অন্দরে ক্ষোভ আছে। এক পলিটব্যুরো সদস্যের মতে, বঙ্গ সিপিএম এ নিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের অন্যত্র জাত-রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সিপিএম-কে অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে।

মতুয়া-মঞ্চে এ রাজ্যের কংগ্রেসও সামিল। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়ার দাবি, "জাত বা ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে কখনও আমরা নেই। মতুয়াদের ব্যাপারটাকে আমরা শুধু নাগরিকত্বের দাবির প্রশ্নে দেখেছি।" এখানেও কান্তিবাবুর পাল্টা বক্তব্য, "নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটা ২০০৩ সালে পাশ হয়। তখন মমতা এনডিএ-তে আর সংসদের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। এখন মমতা, মানস ভুঁইয়া বা আমাদের দলের নেতারা ওই নাগরিকত্বের দাবি সমর্থন করলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত দিন কী করছিলেন?"

মতুয়া তো বটেই। ভোটের আগে কলকাতায় উর্দুভাষী মুসলিমদের একটি সম্মেলনে তৃণমূলের তরফে উপস্থিত ছিলেন সুলতান আহমেদ, অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আবেগকে এ ভাবে রাজনৈতিক 'মদত' দিতে থাকলে ভবিষ্যতে এমন দাবি বেড়েই চলার আশঙ্কা কি তাঁরা করছেন না? সরাসরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। জ্যোতিপ্রিয় বলছেন, "মুসলিম আর মতুয়ারা একটা করে শক্তিশালী অংশ। মতুয়াদের জন্য মঞ্জুলকৃষ্ণকে গাইঘাটা আসনটা ছেড়ে দেওয়া সেই কারণেই।

এঁদের বাইরে অন্য কেউ এখনও কিছু দাবি করেনি। তবে পরে দাবি উঠতে পারে। তখন ২০-২৫টা আসনে প্রভাব আছে, এমন কোনও গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দাবিও বিবেচনা করতে হবে।"

বিপদটা এই জায়গাতেই! বর্ণ, জাত বা গোষ্ঠী-রাজনীতির যে বাঘে সওয়ার হয়েছে যুযুধান সব পক্ষই, তার পিঠ থেকে নামা প্রতিদিনই কঠিনতর হবে!


প্রবন্ধ...

বিশ্বাসটাই থাকল না

সি পি আই এম-এর দম্ভ আর মাওবাদীদের হিংসায় মানুষ লাল পতাকার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।
অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

ত দিন যাচ্ছিল, রাজ্যের সি পি আই এম তথা বামপন্থীদের ধরন-ধারণ, কথাবার্তায় অশ্লীলতা-ঔদ্ধত্য-দ্বিচারিতার পরিমাণ ততই বেড়েছিল। শুরু হয়েছিল সেই 'আমরা ২৩৫ আর ওরা ৩০' দিয়ে। তার পর থেকে এক এক বাম নেতা যেন এক একটি বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছেন! এক জন কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বিরোধী নেত্রীকে যৌনকর্মীর সঙ্গে তুলনা করছেন, তো অন্য জন ব্যঙ্গ করছেন, 'কপালে সিঁদুর পরে না তাই লাল রঙের মর্ম বোঝে না' বলে। যিনি কিছু কাল আগে বলেছেন নন্দীগ্রামে তাঁরা কেমিক্যাল হাব-এর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে যাননি, জনতা ভুল বুঝেছে, তিনিই আবার পরে জনসভায় হুঙ্কার ছাড়লেন, নন্দীগ্রামকে তাঁরা হলদিয়া বানিয়ে ছাড়বেন।

দেখলাম, জনমত বিরুদ্ধে গেলেই নেতা ক্ষমা চান। সেই ক্ষমা চাওয়াটাও, দেখা গেল, ভোটযুদ্ধে বামপন্থী কৌশলের অঙ্গ। এক সি পি এম সংগঠক বললেন, এই যে ক্ষমা চেয়ে আমরা মানুষের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছি, এতে আবার জনগণ আমাদের দিকে ফিরে আসছেন। কলা ও কৌশলে সিদ্ধহস্ত বামপন্থী পার্টি। ভোটের প্রাক্কালে রাজ্যের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি-র প্রথম সারির নেতার অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল, কংগ্রেস-তৃণমূলে ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া! নিজেদের মতাদশের্র পতাকা আকাশে তুলে ধরা নয়, সেই পতাকার তলায় আপামর মানুষকে শামিল করার একাগ্র প্রচেষ্টা নয়, নেতার মাথা ওভারটাইম খাটছে জোটের মধ্যে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টায়! পরিণামে এখন বামফ্রন্ট ৬২, তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ২২৭।

অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুবাদে এ দেশের বলশেভিকদের কমিউনিস্ট পার্টি তার শিশুকাল থেকেই কত তরুণ-যুবক-প্রৌঢ়ের বিনম্র শ্রদ্ধা সমর্থন পেয়েছে। এর পরে স্বাধীনতা লাভের সাত মাসের মাথায় দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পার্টি এবং সংশ্লিষ্ট 'দেশদ্রোহী' সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপরেও নেমেছে দমন-পীড়ন।

এই সে দিনও কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করতেন, তাঁরা জনগণের ভাল-র জন্য কাজ করছেন, জনগণই তাঁদের ধারণ করবেন। জনগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক জলের মধ্যে মাছের মতো। এমত বিশ্বাসের নির্ভরেই তো, সত্তরের দশকে, নতুন সমাজ গড়বার আকাঙক্ষায়, এক ঝাঁক মেধাবী ছেলেমেয়ে সহ্য করেছে রাষ্ট্রের যাবতীয় দমন-পীড়ন। সত্তর-বাহাত্তরের শ্বাসরোধকারী রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায়, কমরেডদের নিরলস প্রচেষ্টায়, চৌত্রিশ বছর আগে সি পি আই এম— বামফ্রন্ট— ক্ষমতায় আসে। লাল পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে তাঁরা সে দিন বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলেই রাজ্যে বিপ্লব হবে না, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না, কিন্তু সরকার চেষ্টা করবেন জনগণকে কিছু 'রিলিফ' দিতে। জনতার মতামত নিয়ে সরকারের নীতি স্থির করবেন, কর্তব্যাদি সম্পন্ন করবেন— এমন প্রতিশ্রুতিও দেন তাঁরা।

তাঁরা আরম্ভ করেছিলেন মাটির মানুষের দর্শন দিয়ে, কিন্তু তা বেশি দিন প্রয়োগ করলেন না। জনতার থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলেন তাঁরা। অবিবেচনা, অদক্ষতা, অপরিণামদর্শিতা গ্রাস করল তাঁদের। এখন শ্রমিকদের লাল পার্টির এই রাজ্য শ্রমিকদের বকেয়া টাকা গায়েব করে দেওয়ার তালিকায় প্রথম। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড খাতে বকেয়া ৫০০ কোটি টাকা, ই এস আই বাবদ ২৩০ কোটি টাকা মেটায়নি মালিক। পাটশিল্পের শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি বাবদ বকেয়া ২৫০ কোটি টাকা বরবাদ। দেখা গেল, শ্রমিকদের খাটুনির এই টাকা মালিকরা অনায়াসে হজম করে দিতে পারেন এই 'লাল' জমানায়। দেশের রুগ্‌ণ শিল্পের প্রায় ৪৭ শতাংশের ঠিকানা এই রাজ্য। প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিক এই রাজ্যে ন্যূনতম মজুরিটুকুও পান না। বছরে আড়াই শতাংশেরও কম হারে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে! এ রাজ্যে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা ৭৮ শতাংশ। নারী পাচারে রাজ্য প্রথম। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়, তবু পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামাঞ্চলে পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি। রাজ্য সরকারের অদক্ষতার এমনতর বহু তথ্য ক্রমশ প্রকাশিত হল। কিন্তু তা মেনে নিয়ে অবস্থার উন্নতি ঘটানোর বদলে সি পি এম নেতারা নিলেন ঔদ্ধত্যের পথ। জনতাকে 'রিলিফ' দেওয়ার বদলে তাঁরা পুঁজিপতিদের 'রিলিফ' দেওয়ার পথ ধরলেন। সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে কখনও তাঁরা মার্কস-লেনিন উদ্ধৃত করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন কৃষকদের কৃষি থেকে শিল্প-শ্রমিকে পরিণত করাটাই আজকের কর্তব্য। আবার কখনও বললেন, টাটারা ওই জমি চাইল বলে (এই 'সামাজিক ঘুষ') দিতে হল। না হলে অন্য রাজ্যে চলে যেত।

অশোক মিত্র বলেছেন, 'আসলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় যা প্রধান বিতর্ক, তা উন্নয়নতপস্বী ও স্থবিরতাপ্রেমিকদের কোঁদলঘটিত নয়, কৃষি বনাম শিল্প এই ধরনের কাল্পনিক আছড়া-আছড়ি নিয়েও নয়। সমস্যাটি আদর্শানুগত্য বনাম আদর্শবিস্মৃতির।' আদর্শবিস্মৃতি হয়েছে বলেই, ক্ষমতায় থাকার সুবাদে, কিছু বাম নেতা-কর্মী আড়ে-বহরে, ধনে-মানে বেড়ে উঠলেন। পার্টির মধ্যে জন্ম নিল বিশেষ সুবিধাভোগী একটি 'কুলাক' শ্রেণি। এ কথা সি পি এম-এর কেন্দ্রীয় নেতারা ভাল ভাবেই জানেন। তাঁরা এ নিয়ে তাঁদের 'মার্কসিস্ট' পত্রিকায় লিখেওছেন। নেতারা এই অসুখ রোধ করবার কথা বললেও কিন্তু সেই ব্যবস্থাটিকে পাল্টালেন না, যা এই দুর্বিনীত 'কুলাক' শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। ফল যা হওয়ার, তাই হল। বাড়তে থাকল সুবিধাভোগী, অত্যাচারী 'হার্মাদবাহিনী'। এবং তাঁদের সীমাহীন ঔদ্ধত্যের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল অন্য মত। ভিন্ন স্বর। তাঁরা গণতন্ত্র চান, রাজ্যের উন্নতি চান। এ-ও নিশ্চিত বামপন্থা।

তৃণমূল আশ্বাস দিয়েছে 'জনস্বার্থবাহী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকার' হিসেবে কাজ করার। 'মা-মাটি-মানুষের সরকার' গড়তে তৃণমূল যে যে স্লোগান রেখেছে, সেই 'কৃষি আমাদের প্রেরণা, শিল্প আমাদের চেতনা' অথবা 'দলতন্ত্র নয়, গণতান্ত্রিক সরকার' কিংবা তাঁদের নির্বাচনী ইস্তাহারের ঘোষিত উদ্যোগগুলির মধ্যে বামপন্থী বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন বহু মানুষ। জনমনে বামপন্থা থেকেই যায়। তা যেমন এক দিন লাল পতাকার মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছে, আজ ঘাসফুল পতাকার সাহচর্যে উদ্গীর্ণ হল।

অথচ, তৃণমূল একটি সংস্কারবাদী দল মাত্র। অন্য যে কোনও ভোটপার্টির মতো। তারা তো চালু, আর্থসামাজিক ব্যবস্থার 'বদল' ঘটিয়ে সম্পদের সমবণ্টন তথা সমাজতন্ত্র চাইছে না। যা চাইতে পারে লাল পতাকার দল। কিন্তু, মতাদর্শের এই জোরের জায়গাটা সি পি আই এম-এর কাজকর্মে বেমালুম উধাও। সমাজতন্ত্রে উপনীত হওয়ার কর্মসূচির প্রয়োগ তো তারা আগেই কমিয়ে দিয়েছিল, এ বার সমগ্র ভোটপর্বে এ নিয়ে একটি কথাও বলল না মার্কস-লেনিনকে ছবি করে রাখা, সংসদ-সর্বস্ব সি পি আই এম।

রাজ্যের যে দুটি লাল পতাকাধারী দল জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে, ভোটের পরে তাদের কর্মকাণ্ড বিচার করতে বসে বুদ্ধি গুলিয়ে যায়। এক দিকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কক্ষচ্যুত সি পি আই এম বিগত সাড়ে তিন দশকের প্রতিটি দিন একটু একটু করে খর্ব করেছে লাল পতাকার সম্মান। অন্যায় অত্যাচারে হাত পাকিয়ে ক্রমশ তারা ডুবে গিয়েছে দক্ষিণপন্থার অতল গহ্বরে। সাধারণ মানুষ তাকে আর বিশ্বাস করে না। অন্য দিকে, সদ্যোজাত 'লাল' মাওবাদীরা প্রতিবাদী গণসংগঠনে ঢুকে তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়ে, নির্বিচার খতমের পরিত্যক্ত উগ্র বাম রাজনীতি আমদানি করে, ছুটে গিয়েছে আগ্নেয়গিরির শিখরে। এই আত্মহত্যাকামী হঠকারীদের উপরেও সামান্য ভরসা নেই রাজ্যের মানুষের। আগামীতে যে দলই লাল নিশান হাতে মানুষের কাছে যাবে, তাকেই লড়াই করতে হবে রক্তপতাকার এই দুই কারবারির কাজকর্মের প্রতিক্রিয়ায় জমে ওঠা অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে।

হ্যাঁ, আপাতত রাজ্যের মানুষ লাল পতাকার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন। বড় ক্ষতি এটাই।

http://anandabazar-unicode.appspot.com/proxy?p=15edit2.htm

No comments:

Post a Comment