Pages
▼
Friday, August 29, 2025
লিটিল ম্যাগাজিনের আজকের সংকট
লিটিল ম্যাগাজিনের আজকের সংকট: প্রতিবাদের বদলে আত্মপ্রচার
অয়ন মুখোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের ভুবনে লিটল ম্যাগাজিন একসময় ছিল বিকল্প চেতনার প্রাণকেন্দ্র। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত অসংখ্য ক্ষুদ্র পত্রিকা জন্ম নিয়েছিল প্রতিবাদী সাহসিকতার ভিতর দিয়ে। তারা মূলধারার বাজার-চালিত সাহিত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, আবার সাধারণ মানুষের সংগ্রামকেও সাহিত্যের আলোয় এনেছিল। ইতিহাস সাক্ষী, মনে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতার একদল তরুণ কবির সম্পাদিত ছোট পত্রিকার পাতায়; নকশালবাড়ির আন্দোলনের পক্ষে তীব্র কণ্ঠস্বর তুলেছিল এই ক্ষুদ্র পত্রিকাগুলোই; এমনকি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বহু লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ সংখ্যা বের করেছে, শরণার্থী শিবিরের দুর্দশা ও পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা প্রকাশ্যে এনেছে।
সংখ্যার দিক থেকেও তখনকার বিস্তার ছিল বিস্ময়কর। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি এসে পশ্চিমবঙ্গে সাত-আটশ ক্ষুদ্র পত্রিকা নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো। কোন একটি নাম নয় এইরকম অসংখ্য লিটিল আজও ইতিহাসের অংশ। পরবর্তী সময়ে হাল আমলে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময়। লিটল ম্যাগাজিনের রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল স্পষ্ট অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন কেবল সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যমই ছিল না, বরং রাজনৈতিক প্রতিবাদের প্রাণবন্ত মঞ্চও ছিল।
কিন্তু সেই ধারাটি আজ মারাত্মক সংকটের মুখে। ২০০০ সালের পর থেকে লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করে। একসময়ের বিস্ফোরণ সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই-আড়াইশ সক্রিয় পত্রিকায়, তারও অধিকাংশ জেলা বা মহকুমা শহরে সীমাবদ্ধ। আরও বড় সমস্যা হলো, আজকের অনেক লিটল ম্যাগাজিনই প্রতিবাদের জায়গা ছেড়ে এসে নিছক সাহিত্য-আড্ডার মতো হয়ে উঠেছে। কবিতা, ছোটগল্প, বই-সমালোচনা প্রকাশের বাইরে তারা আর বিশেষ কিছু করছে না। রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ, কর্পোরেট দখলদারি কিংবা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মতো বৃহৎ সংকটগুলোকে স্পষ্টভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না।
এখানেই মূল সমস্যা। কারণ লিটল ম্যাগাজিনের ঐতিহাসিক দায় ছিল— মূলধারার বাইরে দাঁড়িয়ে সাহিত্যের ভেতর দিয়ে মতাদর্শগত লড়াইকে এগিয়ে নেওয়া। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, বহু সম্পাদক ও লেখক ব্যক্তিগত স্বীকৃতি, পুরস্কার কিংবা সরকারি অনুদানের মোহে সেই দায় থেকে সরে আসছেন। ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সুযোগ, কিংবা মোটা অঙ্কের গ্রান্ট পাওয়ার লোভ— সব মিলিয়ে সাহিত্যচর্চা ক্রমশ আত্মপ্রচারের উপকরণে পরিণত হচ্ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো, তথাকথিত “বিপ্লবী” লেখকেরা আজ সুস্পষ্টভাবে আরএসএস-বিজেপির প্রকল্পকে প্রশ্ন করতে চাইছেন না। প্রথাগতভাবে এরা তৃণমূল-বিরোধিতার জায়গা থেকে লিখে আসছেন, যা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, একইসঙ্গে তারা ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান এড়িয়ে যাচ্ছেন। বরং ইংরেজি অনুবাদে বই প্রকাশ করে, সংঘী নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুরস্কার গ্রহণ করে কিংবা নরমভাবে হিন্দুত্ববাদী বই প্রকাশে সম্মতি দিয়ে তারা অজান্তেই আরএসএস-বিজেপির বৃহত্তর নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে উঠছেন।
এখানে দ্বিচারিতা স্পষ্ট। জনসমক্ষে এরা বামপন্থী ভাবমূর্তি বজায় রাখছেন, কবিতার ভেতর বিপ্লবী রোমান্টিসিজম ছড়িয়ে দিচ্ছেন; কিন্তু বাস্তবে তারা সহযোগিতা করছেন হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক প্রকল্পকে। এর পেছনে ব্যক্তিগত স্বীকৃতির লোভ, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেটের আকাঙ্ক্ষা এবং আর্থিক সুবিধার প্রলোভন কাজ করছে। ফলে লিটল ম্যাগাজিন, যে প্রতিষ্ঠান একদিন ছিল প্রতিরোধের প্রতীক, আজ তা হয়ে উঠছে ক্ষমতার নেটওয়ার্কের অংশ।
অবশ্যই, সব লিটল ম্যাগাজিনকে একই তরবারির আঘাতে কাটা যায় না। এখনও কিছু ক্ষুদ্র পত্রিকা আছে যারা নিরন্তর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বজায় রাখছে— গ্রামীণ স্তরে, শ্রমিক আন্দোলনের পাশে, কিংবা নারী-দলিত প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে। কিন্তু সংখ্যার বিচারে তারা সীমিত, এবং প্রভাবের দিক থেকে তারা প্রায় অদৃশ্য। শহুরে আলোচনার মঞ্চে বা বইমেলার চকচকে স্টলে এই কণ্ঠগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে— লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ কী? তারা কি আবার সেই পুরনো দায়িত্ব ফিরে নিতে পারবে? নাকি আত্মপ্রচারের বাজারেই মিলিয়ে যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে নতুন প্রজন্মের সম্পাদক-লেখকদের উপর। যদি তারা আবার সাহস করে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ, কর্পোরেট দখলদারি ও হিন্দুত্ববাদকে প্রশ্ন করে, তবে লিটল ম্যাগাজিনের ভেতরে নতুন আন্দোলনের সম্ভাবনা আছে। অন্যথায়, আজকের এই আত্মমুগ্ধ পরিসর ইতিহাসে নিছক সাহিত্য-আড্ডার জায়গা হিসেবেই নথিভুক্ত হবে।
লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয়েছিল প্রতিবাদ থেকে, তার ইতিহাস গড়া হয়েছিল রক্ত-ঘামের লড়াই দিয়ে। সেই ঐতিহ্যই আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। সাহিত্যিক সততা ও মতাদর্শগত দায় যদি হারিয়ে যায়, তবে লিটল ম্যাগাজিন কেবল নামমাত্র ঐতিহ্য হিসেবেই টিকে থাকবে— কার্যকর প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে আর নয়।
অতএব আজকের সম্পাদক ও লেখকদের সামনে দায় একটাই— ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ও সুবিধার প্রলোভন ছেড়ে আবার প্রতিবাদের পথে দাঁড়ানো। না হলে লিটল ম্যাগাজিনের পতাকা যাদের হাতে অর্পিত হয়েছিল, ইতিহাস তাদেরই বিশ্বাসঘাতক বলে নথিবদ্ধ করবে।
No comments:
Post a Comment